• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ইতিহাস ঐতিহ্য প্রকৃতির অপার লীলাভূমি নড়াইল

ইতিহাস ঐতিহ্য প্রকৃতির অপার লীলাভূমি নড়াইল

ফিচার ডেস্ক

নদ-নদী আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি নড়াইল। খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান, দেশসেরা ক্রিকেট অধিনায়ক নড়াইল এক্সপ্রেস খ্যাত মাশরাফির জন্মভূমি এই জেলা। খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক জেলা নড়াইল। ১৮৬১ সালে যশোর জেলার অধীন নড়াইল মহাকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়।

‘নড়াইল’ নামকরণ নিয়ে নানা রকম লৌকিক গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বৃহত্তর যশোর জেলার অধীন নড়াইল সদর, লোহাগড়া ও কালিয়া থানার সমন্বয়ে নড়াইল মহাকুমা গঠিত হয়। ১৯৮৪ সালের ১ লা মার্চ নড়াইল মহাকুমাকে জেলায় রুপান্তরিত করা হয়।

নড়াইল জেলার পশ্চিমে রয়েছে যশোর জেলার বাঘারপাড়া উপজেলা, যশোর সদর ও অভয়নগর উপজেলা। জেলার উত্তরে রয়েছে মাগুরা জেলার শালিখা ও মোহাম্মদপুর উপজেলা। নড়াইলের পূর্বে ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা, গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার অবস্থান।

এই জেলার দক্ষিণে বাগেরহাট জেলার মোল্লারহাট, খুলনার তেরখাদা, দিঘলিয়া উপজেলা ও ফুলতলা উপজেলা এবং যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভৌগলিক অবস্থান। নবগঙ্গা ও চিত্রা নদীর তীরে নড়াইল জেলা যেন প্রাকৃতিক রূপে টইটম্বুর এক জনপদ।

নড়াইলে জাতীয় সংসদের সংসদীয় আসন ২টি। কালিয়া উপজেলা ও নড়াইল উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে নড়াইল-১ এবং লোহাগড়া ও নড়াইল পৌরসভাসহ উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে নড়াইল-২ আসন।

১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ নড়াইল মহকুমার প্রশাসক জনাব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর নেতৃত্বে অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ, জনাব আব্দুল হাই এবং অন্যান্যদের সহযোগিতায় নড়াইল ট্রেজারীর তালা ভেঙ্গে অস্ত্র নিয়ে যশোর সেনানিবাস আক্রমণের মধ্যে দিয়ে এ জেলার মানুষের মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়। অগণিত মুক্তিযোদ্ধার রক্ত এবং অনেক অত্যাচারিত, লাঞ্চিত মা-বোনদের আত্মসম্ভ্রম ও সংগ্রামের বিনিময়ে ১৯৭১ সনের ১০ ডিসেম্বর নড়াইল হানাদার মুক্ত হয়।

নড়াইল জেলা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুক্তিযোদ্ধা অধ্যুষিত জেলা। এ জেলা থেকে প্রায় দুই হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন। দেশের ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের মধ্যে মরহুম ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ নড়াইলের কৃতি সন্তান। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী চিত্রা নদীর পাড়ে লঞ্চঘাটের পন্টুনের ওপর প্রায় তিন হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে বলে ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে।

নামকরণের ইতিহাস

কথিত আছে বাংলার সুবাদার আলিবর্দি খানের শাসন আমলে দেশের বিভিন্ন অংশে বর্গি ও পাঠান বিদ্রোহীরা নানা ধরনের উৎপীড়ন শুরু করে। আলিবর্দির মুঘল বাহিনী বর্গি ও পাঠানদের সম্পূর্ণ শায়েস্তা করতে ব্যর্থ হন। এরপর বর্গি ও পাঠান দস্যুরা তাদের অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলে সুবা বাংলার পশ্চিম ও উত্তর অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রাণভয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকায় পালাতে থাকে। সেই সময় মদনগোপাল দত্ত নামে সুবাদারের এক কর্মচারী কিসমাত কুড়িগ্রামে সপরিবারে নৌকা যোগে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি কচুড়ির শক্ত ধাপের ওপর একজন ফকিরকে যোগাসনে উপবিষ্ট দেখতে পান। ওই ফকির দত্ত মশাইয়ের প্রার্থনায় তার নড়িটি (লাঠি) দান করেন এবং এই নড়ি পরবর্তীতে আশীর্বাদ হয়ে দাড়ায়।

মদনগোপাল দত্ত ফকির বা সাধক আউলিয়ার নড়ি বা লাঠি পেয়ে ধীরে ধীরে প্রতিপত্তি অর্জন করেন। এই ভাবে কিসমাত কুড়িগ্রাম অঞ্চলের ওই স্থানের নাম হয়ে যায় নড়াল। যা পরবর্তীতে নড়াইলে রুপ নেয়।

তবে গবেষণা ও জনশ্রুতি মতে, লড়েআল হতে নড়াইল নামের উৎপত্তি হয়েছে। যারা শক্রর বিরুদ্ধে লড়াই করে স্থানীয় ভাষায় তাদের লড়ে বলে। হযরত খান জাহান আলীর সময়ে রাজ্যের সীমান্তে সীমান্ত প্রহরী নিয়োজিত ছিল। নড়াইল এলাকা নদী নালা খাল বিল বেষ্টিত। খাল কেটে রাজ্যের সীমান্তে পরীখা তৈরী করা হত। খাল বা পরীখার পাশে চওড়া উচু আইলের ওপর দাড়িয়ে লড়ে বা রক্ষী সেনারা পাহারা দিত। এভাবে লড়েআল হতে লড়াল>নড়াইল নামের উৎপত্তি।

এই জেলার প্রধান শস্য ধান, পাট, গম, তেল বীজ, সরিষা, আলু, আখ, কলাই ও খেসারী। বিলুপ্ত অথবা প্রায় বিলুপ্ত শষ্যের মধ্যে রয়েছে নীল, কাউন, তুলা ও বার্লি। প্রধান ফল আম, কাঁঠাল, পেঁপে, কলা, জাম, নারিকেল ও সুপারী।

নদ-নদী

নড়াইল জেলায় অনেকগুলো নদী রয়েছে। নদীগুলো হচ্ছে আঠারোবাঁকি নদী, নবগঙ্গা নদী, চিত্রা নদী, মধুমতি নদী ও ভৈরব নদ। এই জেলায় রয়েছে প্রচুর বিল ও বাওড়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইছামতির বিল ও চাচুরি বিল।

নড়াইলের উল্লেখযোগ্য

নড়াইল জেলার উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে নড়াইল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়, ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট উচ্চ বিদ্যালয়, নড়াইল সরকারী ভিক্টোরিয়া কলেজ, কালিয়া পাইলট হাইস্কুল। জেলার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন, বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ পণ্ডিত শ্যাম শঙ্কর চৌধুরী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সেতার বাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাবা বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্কর, খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান, তেভাগা আন্দোলনের অগ্রপথিক অমল সেন, বীর উত্তম মাসরুর উল হক সিদ্দিকী, ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা, চারণ কবি মোসলেম উদ্দিন।

দর্শনীয় স্থান

নড়াইলের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে নড়াইল জমিদার বাড়ি, হাটবাড়িয়া জমিদার বাড়ি, এস এম সুলতান বেঙ্গল চারুকলা মহাবিদ্যালয়, গোয়াল বাথান গ্রামের মসজিদ, কদমতলা মসজিদ, নলদীতে গাজীর দরগা, উজিরপুরে রাজা কেশব রায়ের বাড়ী, জোড় বাংলায় অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত রাধাগোবিন্দ মন্দির, লক্ষ্মীপাশায় কালিবাড়ী, নিশিনাথতলা, মধুমতি নদীর উপর নির্মিত চাপাইল সেতু, আঠারো বাকি নদীর তীরবর্তী দৃশ্য, চিত্রা রিসোর্ট, ভিক্টোরিয়া কলেজ, চিত্রা নদী, হাটবাড়িয়া জমিদার বাড়ি পার্ক, অমৃত নগর কাচারী বাড়ি (নড়াগাতী)।

২৮ আগস্ট ২০২২, ০৭:১৫পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।