• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রূপে নয়, গুণেই সেরা ‘কুঁচিয়া’

রূপে নয়, গুণেই সেরা ‘কুঁচিয়া’

প্রতিকী ছবি

ফিচার ডেস্ক

কুঁচিয়া। কদাকার উপকারী এক মাছের নাম। বাংলাদেশের হাওর, বাঁওড়, খাল-বিল, পচা পুকুর, ধানখেতসহ বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলে এটি পাওয়া যায়। এরা মূলত স্যাঁতসেঁতে জলাভূমির গর্তে লুকিয়ে থাকে। বাংলাদেশে সবার কাছে কুঁচিয়া পছন্দের তালিকায় না থাকলেও এটির চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও কুঁচিয়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুঁচিয়া চাষ শুরু হয়েছে। সুপ্রাচীন কাল থেকে কথিত আছে, কুঁচিয়া খেলে রক্ত বাড়ে, পাইলস সারে। ওষুধ হিসেবেও অনেকে কুঁচিয়ার মাংস খেয়ে থাকেন।

প্রিয় পাঠক, আজকের পর্বে চলুন দেখে নেয়া যাক, কী আছে কুঁচিয়ায়-

পরিচয় : কুঁচিয়া মাছ বাংলায় নানা নামে পরিচিত। যেমন : কুইচ্চা, কুঁচে, কুঁচো ইত্যাদি। ইংরেজিতেও এই মাছের একাধিক নাম পাওয়া যায়। যেমন : Gangetic mud eel, Rice eel, Mud eel, Swamp eel। এটির বৈজ্ঞানিক নাম Monopterus cuchia। বাংলাদেশ, ভারতের উত্তরাঞ্চল, নেপাল, মিয়ানমার ও পাকিস্তানে কুঁচিয়ার আবাসভূমি।

পুষ্টিগুণ : বাংলাদেশ কৃষি তথ্য সার্ভিসে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুষ্টিমান বিবেচনায় কুঁচিয়া মাছে পুষ্টির পরিমাণ অন্যান্য মাছের তুলনায় বেশি। এতে রয়েছে-ক্যালসিয়াম, চর্বি, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ক্যালরি।

খাবার উপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম কুঁচিয়া মাছে রয়েছে
প্রোটিন ১৮.৭ গ্রাম
চর্বি ০.৮ গ্রাম
কার্বোহাইড্রেট ২.৪ গ্রাম
ভিটামিন ১৪০০ মাইক্রোগ্রাম
ক্যালসিয়াম-১৮৫ গ্রাম এবং
ক্যালরি ৩০০ কিলোক্যালরি।

দেখতে যেমন কুঁচিয়া মাছ : কুঁচিয়ার ফুলকা বিলুপ্ত, তবে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য মাথার দুই পাশে থলে আকৃতির অঙ্গ রয়েছে। এটি আকারে লম্বা ও বাইন মাছের চেয়ে বেশ বড়। এই মাছের শরীর লম্বা বেলুনাকৃতির এবং স্লাইম নিঃসরিত হয় বিধায় শরীর পিচ্ছিল হয়ে থাকে। এই মাছকে আঁশবিহীন মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে গায়ে ক্ষুদ্রাকৃতির আঁশ বিদ্যমান, যার বেশির ভাগ অংশই চামড়ার নিচে থাকে। এই মাছটি খাওয়ার জন্য চামড়া ছাঁড়িয়ে নিতে হয়। প্রকৃতিতে কুঁচিয়া ছোট ছোট পোকামাকড়, জীবন্ত ছোট মাছ, কেঁচো, শামুক-ঝিনুকসহ নানা অমেরুদণ্ডী প্রাণী খেয়ে জীবনধারণ করে থাকে।

কুঁচিয়া হালাল নাকি হারাম : কুঁচিয়া খাওয়ার ব্যাপারে অন্য কোনো ধর্মে নিষেধ নেই। এ ব্যাপারে ইসলামী শরিয়তেও নিষেধাজ্ঞা নেই। কয়েকটি মাসয়ালায় বলা হয়েছে, সামুদ্রিক প্রাণী যা পানিতে থাকে, তা কাঁকড়া/কুঁচিয়া হোক বা অন্য প্রাণী হোক তা খাওয়া হালাল (আল মুকনে ২৭/২৮২ মাসআলা নং ৪৬২৬)। এছাড়া হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেন, সমুদ্রের পানি পবিত্র এবং তার মৃত প্রাণী হালাল (আবু দাউদ, বুলূগুল মারাম, পবিত্রতা অধ্যায় ১, হাদিস ৮৩)।

আলেম ওলামারা বিভিন্ন মাসয়ালার ব্যাখায় বলেছেন, কাঁকড়া বা কুঁচিয়া খাওয়া জায়েজ। এটি একজনের রুচির ওপর নির্ভর করবে। কারণ নবী (সা.) হাদিসের মধ্যে বলেছেন, সমুদ্রের অথবা নদীর মধ্যে, যেই মৃত প্রাণী আছে, সেগুলো সবটাই হালাল। এর মধ্যে কাঁকড়া, কুঁচিয়া বা অন্যান্য প্রাণীও অন্তর্ভুক্ত হবে। (আবু দাউদ হাদিস নাম্বার ৮৩)।

উপকারিতা : বাংলাদেশ কৃষি তথ্য সার্ভিস ও উইকিপিডিয়ায় প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়েছে, কুঁচিয়া মাছ-

শক্তি বৃদ্ধি করে : কুঁচিয়ার মাংসে রয়েছে প্রচুর ক্যালরি, যা দেহে শক্তি জোগায়। এতে থাকা উচ্চ ক্যালরি ও প্রোটিন দেহে শক্তি বাড়ালেও ওজন বৃদ্ধি করে না।

হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় : কুঁচিয়ার মাংসে আছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা হৃদযন্ত্র ভালো রাখতে সহায়তা করে।

রক্ত বৃদ্ধি করে : এতে আছে ভিটামিন বি-২, ফসফরাস ও পটাশিয়াম। এসব উপাদান মানবদেহে রক্তের লোহিত কনিকা বৃদ্ধি করে। এছাড়া এটি রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি উন্নত করে।

মস্তিষ্ক ভালো রাখে : মস্তিষ্কের বিকাশ ও স্মৃতিশক্তি শক্তি উন্নত করতে কুঁচিয়া কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এছাড়া এটি স্টেরয়েড উৎপাদনেও কার্যকর।

যৌনশক্তি বৃদ্ধি করে : গবেষকরা বলছেন, কুঁচিয়ার মাংস যৌনশক্তি বৃদ্ধিতে ব্যাপক কার্যকরী। এটি প্রাচীন কাল থেকে বাংলাদেশ, ভারতসহ এ অঞ্চলের মানুষের একটি বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, কুঁচিয়ায় রয়েছে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক মৌল, যা মানবদেহের ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে যৌনশক্তি উন্নত করে।

হাড় মজুবত করে : কুঁচিয়ার মাংসে রয়েছে পর্যাপ্ত ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম, যা হাড় ও দাঁত মজবুত করতে সহায়তা করে।

ওষুধি গুণাগুণ : বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী বিশেষত উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে এ মাছ ব্যাপক জনপ্রিয়। উপজাতীয় সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে, এ মাছ খেলে শারীরিক দুর্বলতা, রক্তশূন্যতা, অ্যাজমা, রক্তক্ষরণ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগসমূহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। এ মাছের বায়ুথলি তাজা বা শুকনা অবস্থায় খেলে অ্যাজমা ও বাতজ্বর আর বাড়ে না।

রক্তশূন্যতা ও পাইলস নিরাময় : কথিত আছে, কুঁচিয়া মাছের মাংসের সুপ বা মাংসের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের হার্বস মিশিয়ে রান্না করা তরকারি খেলে রক্তশূন্যতা ও পাইলস রোগ নিরাময় হয়। গবেষকরাও এ বিষয়গুলো মেনে নিয়েছেন।

সতর্কতা : কুঁচিয়ার মাংস উপকারী খাবার হলেও এটি খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। বিশেষ করে যারা অ্যালার্জি, চুলকানি ও লাল ফুসকুড়িতে ভুগছেন, তারা এটি এড়িয়ে চলুন। উচ্চশক্তি সমৃদ্ধ খাবার হওয়ায় নিয়মিত না খেয়ে এটি মাঝে মাঝে খেতে পারেন।

তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ কৃষি তথ্য সার্ভিস, উইকিপিডিয়া ও মৎস গবেষণা ইন্সটিটিউট ওয়েব

 

এবি/এসএন/আরএ

১৮ নভেম্বর ২০২১, ০৭:৫৬পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।