• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
বাংলাদেশ ব্যাংক

হ্যাকিংয়ের পর যেভাবে চলছে বৈদেশিক আর্থিক লেনদেন

হ্যাকিংয়ের পর যেভাবে চলছে বৈদেশিক আর্থিক লেনদেন

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

সাইবার হামলায় হ্যাকিংয়ের শিকার হয়ে ৮১ মিলিয়ন ডলার হারানোর পাঁচ বছর পরও বৈদেশিক আর্থিক লেনদেনের বার্তা প্রেরণের সুরক্ষিত নেটওয়ার্ক 'সুইফট' পুনর্নির্মাণ করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘সুইফট’ নেটওয়ার্ক না থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ম্যানুয়ালি বৈদেশিক লেনদেন পরিচালনা করা ছাড়া বর্তমানে আর কোনো বিকল্প নেই। আগামী বছরের জুনের মধ্যে সুইফট নেটওয়ার্ক পুনর্নির্মাণ না করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে দেবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লেনদেনের দিন ইতোমধ্যেই কমেছে। প্রতি মাসেই বেশ কয়েকদিন স্থানীয়ভিত্তিক একটি বিদেশী ব্যাংকের সাহায্যে লেনদেন করতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। যদি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক লেনদেন পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংককে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সমস্ত বৈদেশিক লেনদেন কার্যক্রম চালাতে হবে। এতে কমে যাবে ব্যাংকের সুনাম।

তাছাড়া নেটওয়ার্ক পুনর্র্নিমাণে সহায়তার জন্য বাংলাদেশে নিজেদের কোনো কর্মকর্তাই পাঠায়নি সুইফট। ফলে, বাংলাদেশ ব্যাংককে ম্যানুয়ালি বৈদেশিক লেনদেন চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে।

আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাংক লেনদেন চালানোর জন্য একটি বৃহৎ মেসেজিং নেটওয়ার্ক সরবরাহ করে থাকে সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন অর্থাৎ সুইফট। এই মেসেজিং নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংক অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত, নির্ভুলভাবে, ও নিরাপদে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে।

সুইফট মেসেজিং পরিষেবা বিশ্বের ২০০টিরও বেশি দেশ এবং অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়। ১১ হাজারেও বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই পরিষেবা ব্যবহার করে থাকে। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সঙ্গে বৈদেশিক অর্থ আদান-প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একমাত্র বিকল্প সুইফট।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, "সুইফট অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে। এক্ষেত্রে একটি তৃতীয় পক্ষের অডিট প্রয়োজন। বর্তমানে তা করা হচ্ছে।"

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল গণমাধ্যমকে বলেন, "আমরা সমস্ত প্রয়োজনীয় ডিভাইস কিনে সুইফট সিস্টেম পুনর্র্নিমাণ করতে প্রস্তুত। এখন শুধু সুইফটকে তাদের কর্মকর্তাদের এখানে পাঠাতে হবে।" তিনি আরও জানান, সুইফট তাদের কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে পাঠাতে চায়। তবে, দেশে আসার পর রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তাদেরকে জেরা না করার নিশ্চয়তা চেয়েছে তারা।

এদিকে বাংলাদেশ পুলিশও সেই নিশ্চয়তা দিতে চায় না। এ কারণেই সুইফট সিস্টেম পুনর্নির্মাণে বিলম্ব হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

যেভাবে চলছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেন

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ার অধীনে, সুইফট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বৈদেশিক অর্থ প্রদানের জন্য তিনটি ধাপ বজায় রাখতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। অর্থ প্রদানের জন্য একটি সুইফট বার্তা তৈরি হয় প্রথম ধাপে। এরপর দ্বিতীয় ধাপে মনোনীত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা রিসিভারকে একটি ইমেইলের মাধ্যমে বার্তাটি নিশ্চিত করেন। তৃতীয় ধাপে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা পেমেন্ট কার্যকর করার জন্য একটি নির্দিষ্ট নম্বর থেকে প্রাপকের কাছে একটি ফোন কল করেন।

ম্যানুয়াল সিস্টেমে ইমেইল নিশ্চিত করার জন্য একজন কর্মকর্তাকে মনোনীত করতে হবে রিসিভারকে। এরপর অর্থপ্রদান কার্যকর করার জন্য ফোন কলে উপস্থিত থাকতে হবে তাদেরকে। পেমেন্ট গ্রহণকারীদের জন্য এই পদ্ধতি বেশ ব্যয়বহুল। কারণ এক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে লেনদেনের জন্যই অতিরিক্ত জনবল মোতায়েন করতে হবে।

দীর্ঘ বছর ম্যানুয়াল কার্যক্রম চলার পর বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে সতর্ক করে ফেড। যেখানে সুইফট স্বয়ংক্রিয় মেসেজিং সিস্টেমের মাধ্যমে প্রতিদিন সারা বিশ্ব থেকে প্রচুর লেনদেনের আদেশ সহজেই কার্যকর করা যায়, সেখানে শুধুমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেন সম্পাদনের জন্য একজন অতিরিক্ত কর্মকর্তা মোতায়েন করতে হয়েছিল তাদের।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেনের পরিমাণ প্রাপকের জন্য উল্লেখযোগ্য না হওয়ায় অতিরিক্ত জনবল মোতায়েন করা ফেডের জন্য সাশ্রয়ী নয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতিদিন ৫০ থেকে ২০০টি বিদেশী লেনদেন সম্পাদন করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি লেনদেনও।

ম্যানুয়াল সিস্টেমের কারণে ফেড ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য লেনদেনের নির্ধারিত দিন কমিয়ে দিয়েছে। সপ্তাহে এক-দুই দিন বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে ফেডের সঙ্গে লেনদেন চালাতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। এছাড়া এই লেনদেনের জন্য বিদেশী ব্যাংককে কমিশন দিতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, হ্যাকাররা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ নিউইয়র্কের বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে। এই অর্থের ৮১ মিলিয়ন ম্যানিলার রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) চারটি অ্যাকাউন্টে ও আরও ২০ মিলিয়ন স্থানান্তরিত হয় শ্রীলঙ্কার একটি ব্যাংকে। তবে টাকা স্থানান্তরের সময় একটি বানান ভুলের কারণে শ্রীলঙ্কার ২০ মিলিয়ন ডলার হাত ছাড়া হয়ে যায় হ্যাকারদের। শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে সেই টাকা পরে ফেরত পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরবর্তীতে দায়িত্বে অবহেলার কারণে ফিলিপাইনের আরসিবিসি-এর কাছ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিমাণ জরিমানা আদায় করেছিল, তা থেকে প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলার পুনরুদ্ধার হয়। তবে, এখনও প্রায় ৬৬ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

 

এবি/এসএন

২৩ নভেম্বর ২০২১, ০৩:৪৭পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।