• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

যে ব্যক্তির কারণে বাঙালির ‘চিরকালের বন্ধু’ হলো জাপান

যে ব্যক্তির কারণে বাঙালির ‘চিরকালের বন্ধু’ হলো জাপান

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাপানের তৎকালীন সম্রাট প্রয়াত হিরোহিতো একবার বলেছিলেন, “যতদিন জাপান থাকবে, বাঙালি খাদ্যাভাবে, অর্থকষ্টে মরবে না। জাপান হবে বাঙালির চিরকালের নিঃস্বার্থ বন্ধু।” ‘কুষ্টিয়ার ইতিহাস’ বইয়ে এমন কথা উল্লেখ করেছেন গবেষক মুহম্মদ এমদাদ হাসনায়েন এবং তার স্ত্রী সারিয়া সুলতানা।

সম্রাট হিরোহিতো একজন বাঙালিকে লক্ষ্য করে এমন বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং এটি ছিল একজন বাঙালির প্রতি জাপানের কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ। এই বাঙালি ব্যক্তিটির জন্ম বাংলাদেশের কুষ্টিয়াতে।

আর সেই বাঙালি ব্যক্তিটি হলেন- রাধা বিনোদ পাল। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি শিক্ষক ও আইনজীবী। যার জন্ম ১৮৮৬ সালে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ছালিমপুর গ্রামে। বেড়ে উঠেছেন কুষ্ঠিয়া ও রাজশাহীতে। যদিও তিনি দেশ বিভাগের পর ভারতের নাগরিক হয়েছিলেন।

প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষের স্মৃতির সম্মানে জাপানের টোকিওর চিয়োদা অঞ্চলে ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইয়াসুকুনি স্মৃতিসৌধ। এই স্মৃতিসৌধ মূলত জাপানের পক্ষে-বিপক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে অথবা যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কোনো ধরণের সহিংসতার শিকার হয়ে মৃতদের স্মরণে। এই স্মৃতিসৌধ সকল মৃতদের স্মরণে, তবে এটিতে একজনের নাম আছে, যিনি জীবিত ছিলেন। আর সেই ব্যক্তিটি হলেন- রাধা বিনোদ পাল। যদিও তিনি যুদ্ধ বা সহিংসতায় অংশও নেননি, কিংবা নিহতও হননি।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ভারতীয় নাগরিককে জাপানে জাতীয় বীরে পর্যায়ের সম্মাননা দেয়া হয়। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ২০০৭ সালে তিনদিনের জন্য ভারত সফরে এসে রাধা বিনোদ পালের ছেলে প্রশান্ত পালের সাথে দেখাও করেন।

বিবিসি জানিয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন করা হয়, সেই টাইব্যুনালের এগারো জন বিচারকের একজন ছিলেন রাধা বিনোদ পাল।

ওই ট্রায়ালে এগারোজন বিচারকের মধ্যে শুধুমাত্র রাধা বিনোদ পালই জাপানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে রায় দিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে জাপানের পক্ষে মি. পালের রায়ের জন্যই ওই ট্রায়ালের কয়েকজন বিচারক প্রভাবিত হয়ে তাদের রায় কিছুটা নমনীয় করেছিলেন।

কুষ্টিয়া জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে 'কুষ্টিয়ার ইতিহাস' নামে একটি বই লিখেছেন মুহম্মদ এমদাদ হাসনায়েন এবং তার স্ত্রী সারিয়া সুলতানা, যেখানে উঠে এসেছে রাধা বিনোদ পালের শৈশবের নানা ঘটনা।

রাধা বিনোদ পালের কর্মজীবনের শুরুটা হয় ময়মনসিংহে, আনন্দমোহন কলেজের গণিতের শিক্ষক হিসেবে। শিক্ষকতার পাশাপাশি আইন বিষয়ে পড়াশোনাও চালিয়ে যান, দায়িত্ব পালন করেন কলকাতা ল কলেজের অধ্যাপক হিসেবেও। ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

১৯৪৬ সালে রাধা বিনোদ কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ছালিমপুরে ফিরে আসেন। কিন্তু সে বছরই এপ্রিল মাসে তিনি আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পান। পরে ১৯৬৭ সালে রাধা বিনোদ পাল ইহলোক ত্যাগ করেন।

গবেষক হাসনাইন তার লিখিত বইয়ে লিখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই বিজয়ী মিত্রশক্তি সিদ্ধান্ত নেয় যে, যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধের সময় সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের জন্য প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, সেনা কর্মকর্তা ও যুদ্ধাপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট আরও কিছু ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনবে। সে আলোকে ১৯৪৫ সালে লন্ডন সনদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রপক্ষে থাকা দেশগুলো ছাড়াও গ্রিস, ডেনমার্ক, পোল্যান্ড, তৎকালীন যুগোস্লাভিয়া সহ অন্তত ২০টি দেশ ওই চুক্তির অংশ ছিল। নুরেমবার্গ ট্রায়ালের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করেই পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা করা হয় ট্রাইব্যুনাল ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ফার ইস্ট, যেটি টোকিও ট্রায়াল হিসেবেই পরিচিত।

টোকিও ট্রায়ালে এগারো জন বিচারককে অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই এগারো জন বিচারকের মধ্যে একজন ছিলেন রাধা বিনোদ পাল। বাকি দশ জন বিচারক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড ও ফিলিপিন্সের নাগরিক।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলসের ইতিহাসের অধ্যাপক বিনয় লালের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে, সেসময় এমন একজন বিচারককে এই ট্রাইব্যুনালের অংশ রাখা হয়েছিল, কারণ ভারত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের অংশগ্রহণ ছিল।

অধ্যাপক বিনয় লাল বলেন, ট্রাইব্যুনালের অধিকাংশ বিচারক যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং শান্তিবিরোধী অপরাধের দায়ে জাপানের নেতাদের দোষী সাব্যস্ত করলেও রাধা বিনোদ পালের রায় ছিল তাদের বিপরীত।

এমদাদ হাসনায়েন তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, “ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে রাধা বিনোদ পালের প্রধান প্রশ্ন ছিল, যারা জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তাদের নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন করার এবং নিজেদের শর্ত অনুযায়ী পরাজিত শত্রুদের বিচার করার নৈতিক অধিকার আছে কি না।”

রাধা বিনোদের সঙ্গে সুর মেলান নেদারল্যান্ডস ও ফিলিপিন্সের একজন বিচারপতি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়কে অনেকটা বাধ্য হয়েই মেনে নিয়েছিলেন। বিচারক রাধা বিনোদ পাল তার রায়ে মন্তব্য করেন, তৎকালীন সময়ে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সের মত যেসব দেশের উপনিবেশ ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে, সেসব দেশের মানুষের ওপর যুদ্ধকালীন সময় ছাড়াও তারা শান্তি বিরোধী ও মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে।

রাধা বিনোদ পালের বক্তব্য ছিল, ট্রায়ালে জাপানকে যেসব অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হচ্ছে, অভিযোগকারী পক্ষরা নিজেরাই সেসব অপরাধ সংঘটন করে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ। রাধা বিনোদ পাল তার ৮০০ পৃষ্ঠার রায় লেখেন। কিন্তু রায় প্রকাশিত হওয়ার আগেই তা জাপানে নিষিদ্ধ করে অধিগ্রহণকারী মার্কিন বাহিনী।

তবে ঠিক যেদিন মার্কিন বাহিনী জাপান ছেড়ে চলে যায়, সেদিনই রাধা বিনোদ পালের অবিস্মরনীয় রায়টি জাপানে প্রকাশিত হয়। আর একটি রায়-ই রাধা বিনোদ পাল ও বাঙালি জাতিকে জাপানে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করে। পরবর্তীতে রাধা বিনোদ পাল দু'বার জাপানে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে সফর করেন।

১৯৬৬ সালের অক্টোবরে জাপানের সম্রাট হিরোহিতো তাকে জাপানের সর্বোচ্চ অ্যাকাডেমিক খেতাব 'ফার্স্ট অর্ডার অব সেক্রেড ট্রেজার' প্রদান করেন। তথ্যসূত্র- বিবিসি বাংলা।

 

এবি/এসএন

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৪:৫১পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।