• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
মিল্টন সমাদ্দারদের লালন করছে কারা?

মুখ ও মুখোশের আড়ালে ভয়ঙ্কর মানবতা

মুখ ও মুখোশের আড়ালে ভয়ঙ্কর মানবতা

ছবি- সংগৃহিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

মুখোশ পরা মানুষ চেনা দায়। কেউ যদি অন্তরের বাসনা আড়াল করে নিজের ভিন্ন রূপ প্রকাশ্যে রেখে চলে, তাকে কীভাবে চিনবেন। কথায় আছে- ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদুর।’ বহুরূপি মানুষের সংখ্যা এখন বেড়েই চলেছে। বেড়ে চলেছে নিত্য নতুন প্রতারণার ছক। অভিনব প্রতারণার নিত্যনতুন কৌশলে সর্বশান্ত হচ্ছে মানুষ, হারাচ্ছে জীবন। প্রতিটি প্রতারণার গল্পের পেছনে মুখোশ পরা মানুষের যোগসাজশ থাকে। এই মুখোশ একজন ভয়ঙ্কর মানুষকেও মানবিক ও মানবতাবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়। কিন্তু আদতে আসল খবর রয়ে যায় অগোচরেই।

সম্প্রতি দেশে একজন মানবতার ফেরিওয়ালার কেচ্ছাকাহিনী ফাঁস হয়েছে। রাস্তা ঘাঁটে ঘুরে বেড়ানো অসহায় মানুষকে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন মিল্টন সমাদ্দার নামের ওই ভদ্রলোক। গড়ে তুলেছেন শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র। নিয়মিত তাদের পরিচর্যা ও দেখভালের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করতেন মিল্টন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে তিনি প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ টাকা অনুদান পেতেন। অনেক সাধারণ মানুষ মিল্টন সমাদ্দারের মানবিক কাজের প্রশংসা করতেন। তার কাজে সহায়তা করতেন দেশে-বিদেশে থাকা অসংখ্য মানুষ।

কিন্তু কে জানতো, এই মিল্টন সমাদ্দারের মানবিকতার আড়ালে এক ভয়ানক কসাই রূপ লুকিয়ে রয়েছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে মিল্টন সমাদ্দারকে নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করতে গিয়ে শরীরের লোম খাড়া হওয়ার জো। কি বিভৎস, কত ভয়ঙ্কর প্রতারণা। মানবিক আশ্রয়, চিকিৎসার আড়ালে মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গ নিয়ে ব্যবসা করা দুসাহসিক বটে।

মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবসা করা দন্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু সামাজিক কাজের ও মানবিক কাজের সাইনবোর্ড টানিয়ে দেদার অপরাধ করে যাচ্ছে এরকম বহু মিল্টন সমাদ্দার। গণমাধ্যম বলছে, অসহায় মানুষের নামে সংগ্রহ করা অর্থ আত্মসাৎ করেছেন মিল্টন। জাল মৃত্যু সনদ তৈরি এবং জমি দখলের মতো গুরুতর অভিযোগও রয়েছে এই কথিত মানবিক মানুষটির নামে।

সবশেষ গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো আমলে নিয়ে মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো তদন্তের ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। জনস্বার্থে এ বিষয়ে কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত অভিযোগও গ্রহণ করেছে। গত ২৮ এপ্রিল মানবাধিকার কমিশন থেকে মিল্টনের অভিযোগের বিষয়টি নিবিড়ভাবে তদন্ত করে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও দ্রুত কমিশনে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারকে বলা হয়েছে।

এছাড়া এ সব অভিযোগের ব্যাপারে ছায়াতদন্ত শুরু করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এমনকি সমাজসেবা অধিদপ্তরও এ ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে।

যেসব অভিযোগ পাওয়া গেল

মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের বৃদ্ধাশ্রম গড়ে রাস্তা থেকে অসুস্থ কিংবা ভবঘুরেদের কুড়িয়ে সেখানে আশ্রয় দেন। সেসব নারী, পুরুষ ও শিশুদের অসহায়ত্ব তুলে ধরে ভিডিও তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন এবং বিত্তবানদের কাছে সাহায্য চান। তার আবেদনে সাড়াও মেলে প্রচুর।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ১৬টির বেশি নম্বর এবং তিনটি ব্যাংক হিসাবে প্রতিমাসে প্রায় কোটি টাকা জমা হয়। এর বাইরে অনেকেই তার প্রতিষ্ঠানে সরাসরি অনুদান দিয়ে আসেন। অথচ এই আশ্রম ঘিরেই ভয়াবহ প্রতারণার জাল বুনেছেন মিল্টন।

তার ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা যায়, আশ্রমে সব সময় আড়াইশ থেকে তিনশ অসুস্থ রোগী থাকেন বলে ফেসবুকে প্রচার করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় যারা মারা যান, তাদের দাফন করেন মিল্টন। আবার তার আশ্রমে অবস্থানকালেও অনেকে মারা যান। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০০ মরদেহ দাফন করেছেন বলে মিল্টন দাবি করেন।

মিল্টন ফেসবুকে জানান, যাদের দাফন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৬০০ জন তার আশ্রমে মারা গেছেন। আর বাকি ৩০০ মরদেহ রাস্তা থেকে এনে তিনি দাফন করেছেন। এসব মরদেহ রাজধানীর মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ও আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বলে দাবি তার। তবে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মিল্টন সমাদ্দারের প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে সেখানে সব মিলিয়ে ৫০টি মরদেহ দাফন করা হয়েছে।

আরও অভিযোগ রয়েছে, এসব মৃত্যু সনদও জাল। এছাড়া ঢাকার দক্ষিণ পাইকপাড়ায় মিল্টন সমাদ্দারের বৃদ্ধাশ্রমের কাছেই বায়তুল সালাম জামে মসজিদ। বৃদ্ধাশ্রমে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের একসময় এ মসজিদেই বিনামূল্যে গোসল করানো হতো। তার মানবিক কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে মসজিদ কর্তৃপক্ষ তাকে এ সুবিধা দিয়েছিল। তবে গোসল করানোর সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্রায় প্রতিটি মরদেহের বিভিন্ন স্থানে কাটাছেঁড়ার দাগ শনাক্ত করেন। এ বিষয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে প্রশ্ন করে মসজিদ কর্তৃপক্ষ। এরপর তিনি ওই মসজিদে মরদেহ পাঠানো বন্ধ করে দেন।

মিল্টনের বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে। সেখানেও জালিয়াতি করে চার্চের ওপর প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আশ্রমের আরেকটি শাখা খোলা হয়েছে সাভারে। সেখানেও রয়েছে জমি দখলের অভিযোগ।

যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করে চলেছেন মিল্টন সমাদ্দার। নিজের পক্ষে কিছু তথ্যপ্রমাণ ও যুক্তিও তুলে ধরেছেন গণমাধ্যমে। কিন্তু তিনি হয়তো জানেন না- ‘যা রটে তার কিছু তো বটে’।

প্রকৃতপক্ষে মিল্টন সমাদ্দারের ব্যক্তি জীবনেও নৈতিকতা বা মানবিকতার বালাই নেই। কিশোর বয়স থেকেই বেপরোয়া ছিলেন এই সমাদ্দার। বহু মানুষ তার কাছে শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন।

এখন কথা হচ্ছে, আমাদের চারপাশে এরকম অসংখ্য মিল্টন সমাদ্দার ঘাপটি মেরে আছে। নিজের আসল রূপ আড়াল করে এরা মানুষকে ধোকা দিয়ে চলেছে। কেউ মানবিকতা, কেউ বা সমাজসেবা কিংবা কেউ দান-সদকার আড়ালে ভয়ঙ্কর অপরাধ কর্মে লিপ্ত। এরকম অসংখ্য খবর আমাদের আশেপাশে রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন সহজেই ভাইরাল হওয়া যায়। আর এই সুযোগটিই নিচ্ছে অসাধু প্রতারক চক্র। প্রতারকরা নানা কৌশলে মানুষকে ঠকিয়ে চলেছে।

তবে, এত কিছুর পরও কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরি। যেসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া অনিশ্চিত। যেমন- মিল্টন সমাদ্দার কিন্তু একদিনে মিল্টন সমাদ্দার হয়ে ওঠেনি। আশ্রয় কেন্দ্রের আড়ালে মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা করা অনেক কঠিন কাজ। এই কাজে বহু শ্রেণির মানুষের যোগসাজশ লাগে। এই যোগসাজশে অসংখ্য মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতা লাগে। মিল্টন সমাদ্দারকে এই সহযোগিতা করলো কারা? মিল্টন সমাদ্দার যেই এলাকায় এরকম কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন, সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের নজরদারি থাকার কথা ছিল। সেগুলো কি হয়েছে?

সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে মিল্টন সমাদ্দার পুরষ্কারও পেয়েছেন। কথা হচ্ছে, এরকম একজন আপাদমস্তক ভন্ড প্রতারক ও পৈশাচিক পেশাজীবী কীভাবে এত উচ্চ পর্যায়ের পুরষ্কার পেলেন? সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি পুরষ্কার দেয়ার আগে খোঁজখবর করেছিল? মিল্টন সমাদ্দারের আজকের এই ভয়ঙ্কর মানুষখেকো রূপ তো একদিনে তৈরি হয়নি। সে ক্রমেই সুযোগ পেয়েছে, তাকে সুযোগ দেয়া হয়েছে। কারা মিল্টন সমাদ্দারদের সুযোগ দিয়েছে? কারা সুযোগ দেয় প্রতারকদের? এখনই যদি ঘোর না কাটে, তাহলে মিল্টন সমাদ্দারেরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। সেদিন কে কাকে ধরবে?

০১ মে ২০২৪, ০৭:০৩পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।