• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মোকাম ফাঁকা করে চলে গেলেন ‘গুরু ফরিদ’

মোকাম ফাঁকা করে চলে গেলেন ‘গুরু ফরিদ’

ফাইল ছবি

আহ্সান কবীর

একদিন শ্যাওড়া হয়ে বারিধারা ডিওএইচএসের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, রাত আটটা প্রায়। কোনো রিকশা নেই। তাই গন্তব্যে যেতে হাঁটাই ভরসা। রেলক্রসিংটা পার হচ্ছি এমন সময় পেছন থেকে একটি মোটরসাইকেল এসে আমার পাশ ঘেঁষে থামলো। আন্তরিক একটি কণ্ঠ বলে উঠলো- জনাবকে কি লিফট দিতে পারি? গন্তব্য কোথায়?

আমি চমক হজম করতে করতে বাইকারের মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে হাঁ হই। আরে, এযে মেজর ফরিদ স্যার, মানে তার কোর্সমেট এবং গুণগ্রাহীদের অতি পছন্দের ‘গুরু ফরিদ’! এমন একজন বিদ্বান, জ্ঞানবৃহস্পতি এবং আমার সঙ্গে স্বল্প পরিচিত (তা-ও অনেক বছর আগে) বয়সে অনেক অগ্রজ ব্যক্তি মোটরসাইকেল থামিয়ে আমাকে লিফট দিতে চাইছেন?

ভাবনা চিন্তা করতে আমাকে আর সময় না দিয়ে তিনি ফের বলে উঠলেন, আরে উঠে পড়ুন। দেরি করার কি দরকার! রিকশা পাবেন না... কথা পরে হবে...

ফরিদ স্যার দশাসই দেহধারী ছিলেন। অনেক আগে যখন আমার সঙ্গে পরিচয় তখন তিনি একটি হোন্ডা রোডমাস্টার বাইক চালাতেন। সেটা তার ফিগারের সঙ্গে মানানসই ছিল বলে মনে হতো। এবার দেখলাম রোড মাস্টারের তুলনায় একটা লিকলিকে অবয়বের ইয়ামাহা হান্ড্রেড (সম্ভবত) নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।

-না স্যার, আমি হেঁটেই...

রাস্তার অস্পষ্ট আলো-আঁধারিতেও আমার মনের ভাব পড়ে নিয়ে বললেন, আরে কিচ্ছু হবে না। সাবধানে চালাবো, উঠেন। সহজাত অমায়িক হাসি তার মুখে।

উনি যেন জানেনই আমার গন্তব্য কোথায়- তাই তেমন একটা কথা জিজ্ঞেস না করে তার বন্ধুর বাসার সামনে নামিয়ে দিলেন (যেই বন্ধুর মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়)।

আমি অবাক। ফরিদ স্যারের সঙ্গে আমার অনেক আগের সেই দেখা হয়েছিল তাঁর কোর্সমেট, ওই সময়ে সম্ভ্রম জাগানিয়া সত্যনিষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা কর্নেল শহীদ স্যারের সূত্রে। ঢাকার বাইরে তিনি বিডিআরের একটি সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। কোনো প্রভাবশালীর ৯ কোটি টাকার অবৈধ ব্যাঙের পায়ের চালান বা চোরাচালান আটকে দিয়ে আলোচনা এবং ঝামেলায় ছিলেন। অনেক প্রলোভন এবং চোখ রাঙানিকে পরোয়া না করেও তিনি দিব্যি খোশ মেজাজে আসন্ন জটিলতা মোকাবেলার অপেক্ষায় ছিলেন। কর্নেল সাহেবকে ওই সঙ্কটে আমি দেখেছি নিরুদ্বিগ্ন, একেবারে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার কাছে সমর্পিত।

তো শহীদ স্যার যখন ঢাকায় আসতেন আমাকে খবর দিতেন। সুযোগ মতো তার সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের এবং আড্ডা চলতো এই অভাজনের। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে শহীদ স্যার আমাকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। উনার ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন- ‘আমার বন্ধু আহ্সান কবীর’ বলে। (এরকম সবার জীবনেই কিছু কিছু ঘটনা থাকে বোধ হয়)।

তো সেবার শহীদ স্যার ঢাকায় এসেছেন কিন্তু আমি সাক্ষাৎ করতে পারিনি। পরদিন চলে যাবেন। আমিও ব্যস্ত ছিলাম। এমন অবস্থায় সন্ধ্যার পর পিলখানায় গেলাম। সারাদিনের মিটিং, ম্যারাথন কনফারেন্স, ব্যক্তিগত কাজ সব মিলিয়ে কর্নেল সাহেব খুব টায়ার্ড তখন। তিনি আমাকে দেখে বললেন, তুমি খাওয়াদাওয়া করে নাও, টেবিলে খাবার দেওয়া আছে। তোমার দেরি দেখে আমি খেয়ে নিয়েছি। আমার এখন কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ না করলেই নয়।

সামনে তার এক আত্মীয়ও বসে ছিলেন এতক্ষণ। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ পরে আমাকে বলে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। কারণ শহীদ স্যার তখন রীতিমতো ঘুমে। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। ঠিক করলাম আরো কিছুক্ষণ দেখে তারপর চলে যাবো।

প্রায় ঘণ্টা আধেক আমি বসে বসে বই-পত্রিকা পড়লাম (মোবাইল তখন এতটা সহজলভ্য আর স্মার্ট হয়ে ওঠেনি)। এমন সময় দেখি বিশালদেহী এক ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে বিছানায় তাকিয়েই বললেন, কিরে ঘুমিয়ে পড়ছিস নাকি? আমি কতো তাড়াহুড়ো করে এলাম। আর তুই...

কিন্তু শহীদ স্যারের সাড়া নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আগন্তুক একটু উচ্চকণ্ঠে বললেন, শহীদ, আমি তাইলে যাই। তুই ঘুমা!

এই কথায় শহীদ স্যার চোখ খুললেন এবং বললেন, দোস্ত সরি সরি। তুই রাগ করিস না। গত তিনদিন ধরে একটানা ধামাকার মধ্যে ছিলাম, রাতে ঘুমাতেও পারিনি। তুই একটু বস। এই যে, কবীরের সঙ্গে পরিচয় নাই তো তোর। কবীর, এ হচ্ছে আমার কোর্সমেট ফরিদ, ফরিদ ও হচ্ছে আমার বন্ধু আহ্সান কবীর, পুরান ঢাকার। দু’জনে গল্প কর। আমি একটু ঘুমিয়ে নেই। পরে উঠে আড্ডা দিব।

তখনো আমার কোনো ধারণাই ছিল না আমাকে কার সঙ্গে আড্ডা দিতে হবে! ফরিদ স্যার আমাকে নিয়ে বসলেন। সময় কোনদিক দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল বোঝার উপায় নেই। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস, ওমর খৈয়াম, নিশাপুর, শাহনামা, মহাকাশ, ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট, কবি হাফিজ, আগে না শোনা শাহনামার অনেকগুলো অসাধারণ গল্প, হাসিসুন বা অ্যাসসাসিনদের প্রসঙ্গ, আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্বাসরুদ্ধকর অনেক ঘটনার প্রাঞ্জল বয়ান বিশেষ করে ভয়াবহ জাপানি এক যুদ্ধজাহাজের ক্যাপ্টেন টনের বেপরোয়া দুর্ধর্ষ কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি উনি এমনভাবে দিচ্ছিলেন যেন আমি চোখের সামনে থ্রি-ডি মুভি দেখছি।

বুঝলাম, ভাগ্যগুণে বিশ্বের তাবৎ বিষয় সম্পর্কে অগাধ জানাশোনা এবং অনন্য সাধারণ বিশ্লেষণী ক্ষমতার এক জ্ঞান সাগরের সম্মুখে উপনীত হয়েছি আমি। আমার ভাগ্য ভাল ছিল সেই স্বপ্নময় আড্ডার রাতে কিছু ‘ঝড়ে বক মরা’র ঘটনাও ঘটেছিল আমার সঙ্গে। কথা যা বলার ফরিদ স্যারই বলছিলেন, তবে মাঝেমধ্যে দু’একবার কিছু বিষয় তিনি প্রশ্ন করতে আমি ঠিক ঠিক উত্তর দিতে পেরেছিলাম- যেমন ওমর খৈয়ামের গুরু কে ছিলেন (মুফাখখারুল ইসলাম), তার অপর দুই বাল্যবন্ধুর একজন নিজাম উল মুলক ও অপরজন গুপ্তঘাতি অ্যাসাসিন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা গুরু কুখ্যাত হাসসান আল সাবাহ বা পর্বতের বৃদ্ধ প্রসঙ্গ। প্রথমদিকে এইসব কিছু জানাশোনার বিষয়ে আমি ঠিক ঠিক জবাব দিতে পেরেছিলাম জেনারেল নলেজ কুইজের মতো। আর ফরিদ স্যার যেসব বিষয় আর প্রসঙ্গের অবতারণা করছিলেন সেসবে আমার অনেক ক্ষেত্রেই জাররা পরিমাণ ধারণাও ছিল না তখন।

রাত পেরিয়ে ভোর ছুঁই ছুঁই। কর্নেল শহীদ চোখ খুলে ঝরঝরে মুডে জিজ্ঞেস করলেন, কই, তোরা চা-টা কিছু খাইছোস?

আরে গুল্লি মার তোর চা-য়ে, আমরা চমৎকার এক আড্ডা দিলাম। তবে আড্ডা শেষ হয়নি, আরেকবার বসতে হবে উনার সঙ্গে।

কিন্তু সেই আড্ডা আর দেয়া হয়নি- আমার দুর্ভাগ্যই বলতে হয়। এরপর একদিন দেখা বইমেলায়। মেলা বইয়ের বোঝা নিয়ে তিনি ফিরে চলছিলেন। পিছে পিছে অনেকেই ছুটছিলেন তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আর ফোন নম্বরের জন্য। ফরিদ স্যার দ্রুত বের হয়ে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই চিনতে পারলেন এবং বললেন- আপনি আইসেন বাসায়, কথা হবে।

তাঁর বিষয়ে তাঁর প্রিয় বন্ধু কর্নেল শহীদের কাছে পরবর্তীতে কমবেশি জেনেছি। এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা গভীর হয়েছে। অনেক মেধাবী অসাধারণ গুণপনা থাকা সত্ত্বেও সার্ভিসে তিনি মেজর র‌্যাংকের ওপরে যাননি- এর পেছনেও সম্ভাব্য কারণটি শহীদ স্যার আমাকে বলেছিলেন- যাহোক, সেসব ভিন্ন প্রসঙ্গ, ভিন্ন কথা।

ফরিদ স্যারের সঙ্গে সর্বশেষ দেখা আমার বারিধারা ডিওএইচএসে বাইক-লিফটের ঘটনায়। তবে তার সঙ্গে অনেকবার ফোনে কথা হয়েছে। প্রতিবারই যেতে বলেছেন তাঁর ঠিকানায় বনানী ডিওএইচএসে। মাস ছয়েক আগে একজন গবেষক হন্যে হয়ে তাঁর ঠিকানা-ফোন নম্বর খুঁজছিলেন। একসহকর্মীর মাধ্যমে আমার সহায়তা চাইলেন। তো যার সঙ্গে জীবনে মাত্র তিনবার দেখা হয়েছে...

আমি ফোন করি ফরিদ স্যারকে। তিনি আমাকে চিনতে পারেন, তবে এবার যেন একটু দেরি হলো। অসুস্থতার মধ্যে যাচ্ছিলেন। যাহোক, এরপর তিনি সেই প্রথমদিনের মতোই আন্তরিক। চাইতেই গবেষকের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিলেন। তবে অপরিচিত ফোন ধরেন না এটাও জানালেন- আমি বললাম, স্যার এসএমএস করলে আপনি রেসপন্স কইরেন, প্লিজ।

ফরিদ স্যার বললেন, আচ্ছা।

স্যার আপনাকে দেখি না অনেক কাল। দেখতে চাই।

তো এসে পড়েন যে কোনোদিন। অনুজ বা জুনিয়রদের ‘তুমি’ সম্বোধন করতেন না খুব সম্ভবত তিনি।

স্যার ঠিকানা?

আরে ঠিকানা লাগবে না। বনানী ডিওএইচএসে এসে যে কোনো রিক্সাওয়ালাকে আমার নাম বললেই হবে। না চিনলে বলবেন, গুরু ফরিদ (একথা বলে তিনি হেসে দিলেন শিশুদের মতো)। অনেক কথা বলার আছে, আড্ডা হবে বললেন। আমি খুব লোভাতুর হয়ে উঠি- এবার যাবোই ‘গুরু ফরিদ’ স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। অনেক অনেক বিষয়ে তার বিশ্লেষণ জানবো, মিলবে আরো ইন্টারেস্টিং টপিকসের সন্ধান।

কিন্তু সেই যাওয়া আর হলো না। বনানী ডিওএইচএসে কোনো রিক্সাচালককে গুরু ফরিদের ঠিকানা বললে হয়তো এখনো নিয়ে যাবে সেখানে, কিন্তু মোকাম ফাঁকা করে মুকিম তো চলে গেছেন!

অনেকদিন অনেক ভাবনায় ভেবেছি, ফরিদ স্যারের কাছাকাছি গিয়ে থাকবো, যাতে এই জ্ঞানসাগরের সান্নিধ্যে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারি। কিন্তু তা আর হয়নি সামনেও আর হবে না অন্তত ইহজগতে- তিনি চলে গেছেন সকল জ্ঞানের আধার সেই মহামহিমের সান্নিধ্যে। করুণাময় উনাকে সম্মানিত ও সৌভাগ্যশালীদের অন্তর্ভুক্ত করে নেবেন- নির্ভীক এক জ্ঞানীর জন্য অভাজনের এই প্রার্থনা রইলো। (৪ মার্চ, ২০২৩ তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।)

 

লেখক: আহ্সান কবীর, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

০৭ মার্চ ২০২৩, ০১:১০পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।