• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

নায়ক রাজরাজ্জাক: বাংলা সিনেমার প্রাণপুরুষ এক শরণার্থী জমিদার

নায়ক রাজরাজ্জাক: বাংলা সিনেমার প্রাণপুরুষ এক শরণার্থী জমিদার

ফাইল ছবি

বিনোদন ডেস্ক

নায়ক রাজ্জাক, জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা বাংলাদেশী নায়ক রাজ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তিনি 'নায়ক রাজ' হিসেবেই পরিচিত। চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি যতটা দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন সেটি বিরল। ১৯৬০-এর দশক থেকে শুরু করে প্রায় তিন দশক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একক প্রভাব বিস্তার করেন নায়ক রাজ-রাজ্জাক।

১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন এই কৃতী অভিনেতা। তাঁর প্রকৃত নাম আব্দুর রাজ্জাক। ১৯৬৪ সালে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নেন ঢাকায়। এরপর তিনি অভিনয়ের নেশায় জড়িয়ে পড়েন চলচ্চিত্রে।

১৯৬৭ সালে নায়ক রাজ-রাজ্জাকের প্রথম সিনেমায় ‘বেহুলা’ মুক্তি পায়। প্রথম সিনেমাতেই তিনি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বাংলা চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান পরিচালক জহির রায়হান নায়ক হিসেবে রাজ্জাককে চলচ্চিত্রে নিয়ে আসেন। ‘বেহুলা’ সিনেমার পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। বাংলা চলচ্চিত্র পত্রিকা ‘চিত্রালী’র সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরী তাঁকে নায়করাজ উপাধি দিয়েছিলেন।

রাজ্জাকের অভিনয় শুরু যেভাবে

জন্মস্থান কলকাতায় সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় প্রথম মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন রাজ্জাক। তবে ১৯৬৬ সালে ১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন চলচ্চিত্রে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় কীংবদন্তী এই অভিনেতার।

অভিনয় জীবনে তিনি বেহুলা, আগুন নিয়ে খেলা, এতটুকু আশা, নীল আকাশের নিচে, জীবন থেকে নেয়া, ওরা ১১ জন, অবুঝ মন, রংবাজ, আলোর মিছিল, অশিক্ষিত, ছুটির ঘণ্টা, বাবা কেন চাকর এবং বড় ভালো লোক ছিলসহ অন্তত ৩০০ শতাধিক বাংলা ও উর্দু ভাষার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন নায়ক রাজরাজ্জাক। ১৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন গুণী এই নির্মাতা। বাংলাদেশের প্রভাবশালী চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘রাজলক্ষী প্রোডাকশন’ নায়করাজের হাতে গড়া।

২০১৫ সালে সংস্কৃতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখায় বাংলাদেশ সরকার নায়ক রাজরাজ্জাককে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। রুপালি পর্দার ঝলমলে ক্যারিয়ারে নায়ক রাজ মোট পাঁচবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করে সরকার।

এছাড়াও তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য বাচসাস পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি প্রথম সভাপতি ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। ২০১৭ সালের ২১ শে আগস্ট ৭৫ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় মত্যুবরণ করেন।

কলকাতার টালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করা আব্দুর রাজ্জাকের বাবার নাম আকবর হোসেন ও মায়ের নাম নিসারুননেছা। নায়ক রাজ্জাকের পূর্বসূরীরা ছিলেন নাকতলা এলাকার জমিদার। তিনি কলকাতার বাঁশদ্রোণীর নিকটে খানপুর হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন। স্কুলে পড়াকালীন শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক ‘বিদ্রোহী’তে গ্রামীণ কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই নায়ক রাজের অভিনয়ের হাতেখড়ি।

রাজ্জাক ১৯৬২ সালে লক্ষ্মীকে বিয়ে করেন নায়ক রাজ। নায়ক রাজ্জাকের স্ত্রীর নাম লক্ষ্মী হলেও তার প্রকৃত নাম খায়রুন্নেসা। কথিত আছে, ১৯৬৪ সালে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে এক রাতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এক হিন্দু পরিবারের বাড়িতে আশ্রয় নেন রাজ্জাক ও তাঁর স্ত্রী। পর দিন ২৬ এপ্রিল পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। সেসময় রাজ্জ-লক্ষ্মী দম্পতির সঙ্গে ছিলেন তাঁদের প্রথম সন্তান বাপ্পারাজ।

অভিনয় জীবন

প্রথমদিকে রাজ্জাক তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পান। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের ১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন এবং কার বউ, ডাক বাবু, আখেরী স্টেশন-সহ আরও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন।

রাজ্জাক-কবরী জুটি

ঢাকাই চলচ্চিত্রে জনপ্রিয়তার ধারাবাহিকতায় সর্বকালের সেরা জুটি রাজ্জাক-কবরি। এই জুটি ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘যোগ বিয়োগ’. ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘অধিকার’, ‘আঁকা বাকা’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘গাঁয়ের বধূ’ নামের চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। রাজ্জাক-কবরি অভিনীত সবগুলো ছবিই ছিল ব্যবসাসফল।

১৯৭৭ সালে প্রথম চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে নায়ক রাজরাজ্জাকের। নায়ক রাজ্জাক পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘অনন্ত প্রেম’, যা রোম্যান্টিক সিনেমা। এই সিনেমার মধ্যদিয়ে ঢাকাই সিনেমায় প্রথম চুম্বনদৃশ্য চিত্রায়িত হয়। যদিও তা শেষ পর্যন্ত মূল ছবি থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল।

১৯৮৯ সালে রাজ্জাক জ্বীনের বাদশা চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এই ছবিতে অভিনয় করেন তার বড় ছেলে বাপ্পারাজ। ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। এ ছাড়া ‘প্রফেসর’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘উত্তর ফাল্গুণী’, নামের চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন নায়ক রাজরাজ্জাক।

চলচ্চিত্রের সকল ক্ষেত্রে অভিনয় করেছেন নায়ক রাজ্জাক। এমনকি তিনি অনন্ত জলিল-বর্ষা অভিনীত হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ ও মোস্ট ওয়েলকাম ছবিতেও অভিনয় করেছেন।

২১ আগস্ট ২০২২, ০৯:৪১পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।