• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা রেলসেতু: আরেকটি মাইলফলক ও অপার সম্ভাবনার দুয়ার

পদ্মা রেলসেতু: আরেকটি মাইলফলক ও অপার সম্ভাবনার দুয়ার

শোভন রায়

‘আমাদের টাকায় আমাদের সেতু- স্বপ্নের পদ্মাসেতু’। স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতু সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে বছরের বেশি সময়। ‘পদ্মার উপর একটি সেতু হবে, রাজধানীর সাথে দক্ষিণের নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপিত হবে’ আমাদের এমন স্বপ্ন ছিল বহুদিনের। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সফল নেতৃত্ব ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাশক্তি উজ্জ্বল বাস্তবায়ন পদ্মা সেতুর মাঝে ফুটে উঠেছে। এই সেতু সড়কপথে যাতায়াত সহজ, সুগম ও সময়সাশ্রয়ী করেছে। এর মধ্যদিয়ে সৃষ্ট আনুসঙ্গিক অর্থনৈতিক ইতিবাচক পরিবর্তনের সাথে সাথে অনানুঙ্গিক প্রভাবের (স্পিল ওভার ইফেক্ট) ক্ষেত্র তৈরি করেছে। যার ফলে অন্যান্য খাতেও পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি প্রবল।

পদ্মা সেতু সড়কপথের পাশাপাশি অর্থনৈতিক অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের আরেকটি মাইলফলক। সবশেষ গত ১০ অক্টোবর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ঢাকা-ভাঙ্গা অংশের ৮২ কিলমিটার পদ্মা রেল লিঙ্ক প্রকল্পের রেলপথ উদ্বোধন করেন। এর ফলে ঢাকা-যশোর রেলপথের প্রথম অংশের বানিজ্যিক ব্যবহারের পথ উন্মোচিত হল। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তথ্য মোতাবেক এই রেললাইন পরবর্তী সময়ে পায়রাবন্দর হয়ে সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটাকে সংযুক্ত করবে। যোগাযোগ স্থাপিত হবে ঢাকা থেকে মংলা বন্দরের। একই সাথে এই রেলপথ চলে যাবে যশোর পর্যন্ত। রেলপথের নতুন রুটের যে অংশ খুলে দেয়া হল, তা ঢাকা থেকে গেন্ডারিয়া হয়ে মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রাথমিক ভাবে এর ফলে খুলনা এবং রাজশাহীর সাথে পদ্মাসেতু হয়ে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলো। যা এই অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত সুগম করবে ও দেশের অর্থনীতির জন্য খুলে দিয়েছে অপার সম্ভাবনার দ্বার।

প্রস্তাবিত সবকটি রেল সংযোগ বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে। যেমন যশোর পর্যন্ত রেলপথ চালু হলে ভারতের সাথে আমাদের যোগাযোগ আরও উন্নত হবে। এই পথে কার্গোরেল চালু হলে পরিবহন খরচ কমবে। এর ফলে ভারত-বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানি ব্যয় কমবে। যা পন্যের দাম কমাতে সহায়ক ভুমিকা পালন করবে। প্রতিবছর শুধুমাত্র বেনাপলো বন্দর হয়ে প্রচুর বাংলাদেশী ভারতে পর্যটন ও চিকিৎসার জন্য ভ্রমণ করে থাকে। নতুন এই যোগাযোগ পথটি চালু হলে তাদের সময় ও শ্রম লাঘবে সহায়তা করবে।

মংলা বন্দর ও পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দরসহ কুয়াকাটার সাথে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে এর বাণিজ্যিক ও পর্যটন গুরুত্ব বাড়বে। মংলা সমুদ্রবন্দরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই মধ্যে এই বন্দর বড় ধরনের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। এখানে স্থাপিত হয়েছে একটি শিল্পাঞ্চল। এই বন্দরের সাথে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ নিরবিচ্ছিন্ন ও সহজ হওয়া দরকার ছিল। যা এই রেল প্রকল্পের দ্বারা নিশ্চিত হবে। ফলে এই বন্দরের বাণিজ্যিক কার্জক্রম বৃদ্ধি পাবে। একই সাথে এই অঞ্চলে নতুন নতুন আরো বিনিয়োগ আসার পথ সুগম হল। যা এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পাশাপাশি জনমানুষের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক ভুমিকা পালন করবে। এতদিন সাতক্ষীরা-বাগেরহাটে উৎপাদিত কৃষি পন্যের ব্যায়বহুল সরবরাহ সংযোগের কারণে কৃষক যেমন ন্যায্য মুল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হত। ভোক্তাকে পন্য কিনতে হত উচ্চমূল্যে। এই রেলপথে লাগেজ ভ্যান ও পন্য পরিবহন ব্যবস্থা সংযুক্ত করার মাধ্যমে পচনশীল কৃষিপন্যের সরবরাহ লাইন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। যা কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের জন্য সুফল বয়ে আনবে।

পায়রা ও কুয়াকাটাকে রেলের আওতায় আনতে পারলে তা দেশের রেল যোগাযোগের হবে এক বিরাট অর্জন। বরিশাল দেশের একমাত্র বিভাগ যেখানে রেল লাইন নেই। যোগাযোগ ব্যাবস্থা অনুন্নত বলে এই অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য কোন শিল্প নেই। এমনকি বিসিকের জায়গাগুলোও একপ্রকার অব্যবহৃত পড়ে আছে। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হবার পড়ে বরিশালে গার্মেন্টস কারখানা স্থাপিত হয়েছে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা যে শিল্পের সাথে ইতিবাচকভাবে সম্পৃক্ত এতই তার উজ্জ্বল উদাহরণ। তাই রেল যোগাযোগের উন্নতির ফলে পায়রার যেমন বাণিজ্যিক গুরুত্ব বাড়বে, সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে পর্যটকের আনাগোনা বাড়বে। যা এই অঞ্চলের অর্থনীতি ও পর্যটনের উন্নয়নে বিশেষ ভুমিকা রাখবে। একই সাথে এই অঞ্চলে শিল্পাঞ্চল ও বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনা তৈরি হবে। আর এখানে শিল্পাঞ্চল হলে দেশের জিডিপি বাড়ার সাথে সাথে এই অঞ্চলের মানুষের আয় ও জীবনমান বাড়বে। সেই সাথে কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকামুখী চাপ কিছুটা হলেও কমবে।

রেল যোগাযোগের জলবায়ুগত প্রভাবও উল্লেখযোগ্য। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাপূর্ণ রেল চালু হলে এই রুটে সড়কের তুলনায় রেলপথের ব্যবহার বাড়বে। রেলের লোড পরিবহন ক্ষমতার তুলনায় কার্বন নিঃসরণের হার অন্য যে কোন পরিবহনের থেকে অনেক কম। সেদিক থেকে চিন্তা করলে রেল ব্যবহারে কার্বন নিঃসরণ কমবে। অন্যদিকে রেল যোগাযোগ ক্ষেত্রে সড়কের তুলনায় জমির ব্যবহার তুলনামুলকভাবে অনেক কম। যা আমাদের মত ছোট দেশের একটি ইতিবাচক দিক বলে বিবেচিত হওয়া উচিৎ।

যদিও উল্লিখিত সকল সুবিধা পাওয়া যাবে পুরো প্রকল্প সম্পূর্ণরুপে বাস্তবায়িত হলে। কিন্তু এরই মধ্যে সচল হওয়া ঢাকা মাওয়া রুটের ইতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাবও দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক পরিবহনসেবা হিসেবে রেল সবসময়ই দেশের মানুষের পছন্দের তালিকায় প্রথম দিকে ছিল। একটা সময় রেলের অব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনাহীনতার কারণে রেল তার অবস্থান কিছুটা হারিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে ব্যাপক বিনিয়োগ, নতুন নতুন পরিকল্পনা ও রুট চালু হওয়ার ফলে রেলের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।

কিন্তু এই প্রকল্পে এখনও বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। যা কিভাবে মোকাবিলা করা হবে তার উপর নির্ভর করবে এর উপকারিতা কতটা কাজে লাগানো যাবে। বিশেষ করে যে প্রস্তাবিত ভাড়ার কথা শোনা যাচ্ছে সেটা আদতে অনেক বেশি মনে হচ্ছে। আমরা দেখেছি জ্বালানীর দাম বাড়ার সাথে সাথে সকল গনপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি পেলেও রেলের ভাড়া বাড়েনি। যা কিছুটা হলেও স্বস্তির বিষয় ছিল। আর গণপরিবহন হিসেবে রেলসেবা মানুষের হাতের নাগালে রাখা উচিত বলে মনে করি। সুতরাং এই রুটের ভাড়া অত্যাধিক বেশি হলে তা যাত্রী ও পন্য পরিবহনের সেবার উপর কেমন প্রভাব ফেলবে তা ভেবে দেখা উচিত। যদিও এই রেল প্রকল্পের ব্যয় অন্য যে কোন রেল প্রকল্প থেকে বেশি ছিল এবং এই ব্যয়ের একটি বড় অংশ এসেছে ঋণ থেকে। সুতরাং এই প্রকল্পকে লাভজনক হতে হবে/করতে হবে তার কোন বিকল্প নেই। ঠিক সেই বিবেচনায় এই ভাড়া প্রস্তাব করা হয়ে কিনা তা এখনও জানা যায়নি। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে শুধুমাত্র যাত্রীর ভাড়াকে আয়ের মাধ্যমে হিসেবে ধরেই ব্যয় মিটানো উচিৎ বলে আমি মনে করি না। পাশাপাশি আরও কোন বিকল্প আছে কিনা বা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে লাভজনক আয় নিশ্চিত করা যায় কিনা তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। তা না হলে এই প্রকল্প সাধারণ যাত্রীদের কতটুকু উপকারে আসবে সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। কারণ উল্লিখিত সকল ইতিবাচক প্রভাব পুরো প্রকল্প সম্পন্ন হবার উপর নির্ভর করছে। আর এই স্বপ্নের প্রকল্প আমাদের অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ অবদান রাখবে বলে বিশ্বাস করি।

লেখক- শোভন রায়। সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, অর্থনীতি বিভাগ, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোনা।

১৪ অক্টোবর ২০২৩, ১১:১৬এএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।