• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

ছিঃ! তুই এ্যাত্ত গরীব!

ছিঃ! তুই এ্যাত্ত গরীব!

প্রতিকী ছবি

আহ্সান কবীর

একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্ত চলছে।
থানায় মৃতের শোকসন্তপ্ত স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
তদন্ত কর্তা : আপনার স্বামীর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ কি?
স্ত্রী: দেখতেই তো পাচ্ছেন, বিষ খেয়ে আত্মত্যা করেছে।
তদন্তকর্তা: হুম, লাশের পাশেই বিষের শিশি পাওয়া গেছে সত্য। কিন্তু কথা হচ্ছে তার শরীর জুড়ে এত আঘাতের চিহ্ন কেন?
স্ত্রী: এমনিতে বিষ খেতে চাচ্ছিল না যে...

উপরের গল্পটি ইন্টারনেটে চলমান হাল আমলের হিট-হট কৌতুকগুলোর একটি। তবে কৌতুকটি মনে দাগ কেটেছে অন্য কারণে। মুনাফার লোভে কাণ্ড-জ্ঞান এবং বিবেক গিলে খাওয়া রক্তচোষা প্রকৃতির ব্যবসায়ীদের কথা মনে পড়ে যায় এর সূত্রে। বলবেন কীভাবে? বলছি-

আজকাল বড় বড় কোম্পানি, চেইন শপ তাদের পণ্যের ওপর মূল্য হ্রাস দিয়ে থাকে হরদম। এজন্য তারা ইদ-পুজো-বড়দিন-বুদ্ধ পূর্ণিমা বা পয়লা বৈশাখের অপেক্ষায় থাকে না। যে কোনো ছুতোয় পর্যায়ক্রমে সারা বছর ধরে চলতে থাকে তাদের কাস্টমার শিকারের ‘বিগ সেল’ কাণ্ড। এজন্য একধরনের ব্যানার পোস্টার ছাপানোই থাকে যা বছর জুড়ে কথিত মূল্য হ্রাস নামক ফাঁকিবাজির নিমিত্তে ক্রেতাদের চোখেমুখে লোভের আছর জমাতে প্রদর্শন করে থাকে তারা।

ধরুন, কোনো বিখ্যাত জুতোওয়ালা ব্যানার টাঙালো যাতে লেখা আছে ৩০% থেকে ৯০% পর্যন্ত মূল্য ছাড় চলছে। তো এমন বিজ্ঞাপন দেখে পাদুকার প্রয়োজন না থাকলেও আপনি ভাল একটা দান মারার আশায় গিয়ে ঢুকলেন স্বপ্ন ঘেরা রঙ ও আলোয় উদ্ভাসিত শোরুমে।

ঢুকে দেখেন, সেখানে থরে থরে সাজানো রয়েছে সব ‘নিউ অ্যারাইভেল’ অর্থাৎ নতুনের সিল মারা সব উচ্চমূল্যের জুতো। আপনি চুপচাপ ঠাণ্ডা মাথায় খুঁজছেন মনপসন্দ খাসা কোনো মাল। কারণ, বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে কমপক্ষে শতকরা ৩০ ভাগ ডিসকাউন্ট মিলবে।
অর্থাৎ এদের কোনো পণ্য যার মূল্য ১০০ টাকা তা এখানে মাত্র ৭০ টাকায় কিনতে পারবেন। শুধু তাই নয়, সর্বোচ্চ ছাড় বলা হয়েছে ৯০%! অর্থাৎ এই হিসেবে যদি ১০ হাজার টাকা দামেরও কোনো জুতো আপনি পছন্দ করেন তবে তা কিনতে আপনার খরচ হবে মাত্র এক হাজার টাকা! এ তো মনে হচ্ছে রীতিমতো মগের মুল্লুক নয় তো শায়েস্তা খাঁর আমল। পানির দাম আর কাকে বলে।

মনে মনে এই কেল্লা ফতে বাজিমাতের সুখভোগ করতে করতে আপনি এক এক করে ওই জুতোর বনে চোখের চিরুনি চালিয়ে খুঁজছেন হ্রাসকৃত মূল্যে আপনার জন্য উপযোগী জুতোটাকে। একপর্যায়ে শোরুমের একতলা-দোতলার (ক্রেতা ঠকানো এই ধরনের শোরুমগুলো আজকাল কমপক্ষে দুইতলা হয়ে থাকে) সব তাক খুঁজে আপনার চোখ মন দুই-ই ক্লান্ত। প্রায় সবই তো দেখা যাচ্ছে নয়া আমদানির উচ্চমূল্যের জুতো! এর বাইরে যেগুলো রয়েছে সেগুলোও তো উচ্চমূল্যের। কিন্তু বাইরে অতবড় ব্যানারে তবে কি মিছে কথা লেখা হলো!

এপর্যায়ে আপনি আর না পেরে লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে মিনমিনে এবং চোর চোর গলায় সামনে থাকা কোনো সেলসপারসনকে জিজ্ঞেস করলেন- ভাই, আপনাদের বিগ সেলের জুতোগুলো কোথায়?

এইবার শুরু হবে আসল রগড়। ওই সেলসপারসন আপনার দিকে এমন একটা দৃষ্টিতে তাকাবে যে মনে হবে আপনি দেশের সবচেয়ে হতদরিদ্র ব্যক্তিটি সবচেয়ে অভিজাত দোকানে ঢুকে পড়ে ব্রহ্ম পাপ করে ফেলেছেন। এসময় তার সঙ্গে চোখাচোখি হলে আপনি স্পষ্ট পড়তে পারবেন সেই অদৃশ্য তিরষ্কার যা মনে মনে আউড়াচ্ছে সে- ছিঃ! তুই এ্যাত্ত গরীব! রিডাকশনের মাল কিনতে এসেছিস ফাঁকতালে? শরম নেই? বেলাজা কোথাকার!

এইরকম সিনারিওতে এরপরই সেখানে ম্যানেজার গোছের কারো আগমন ঘটে। তিনি ‘সমস্যা কি’ ধরনের প্রশ্ন করতেই সেলসম্যান খুব নিচু স্বরে ফিঁস ফিঁস করে কি যেন বলেন (মনে হবে স্কুলপড়া কিশোরী মেয়েটি গৃহশিক্ষকের সঙ্গে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে, আর সেই লজ্জা ও ভীতিকর সংবাদটি মেয়েটির মা জানাচ্ছে তার বাবাকে)।

এরপর! এতক্ষণ তো যাহোক সেলসপারসনের দৃষ্টিতে আপনি কিছু একটা অবস্থানে ছিলেন। কিন্তু এবার ম্যানেজারের লেজার দৃষ্টির সামনে শরম ঢাকার সর্বশেষ অনুসঙ্গ নেংটিটিও বুঝি খুলে যায় অদৃশ্যে! তিনি ‘অ...ওয়াও...আ...’ ধরনের একটা আজীব বিদঘুটে শব্দ করে আপনার দিকে তাকিয়ে চরম বিরক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে গটগট করে চলে যাবেন অন্য কোনো কেতাদুরস্ত ক্রেতার দিকে।

ওদিকে সেলসম্যানের গলায় তখন ঝড়ে পড়বে বিনয়ের অনাকাঙ্খিত মধুকণ্ঠ। তিনি বিপদের দিনে চরম উপকারী বন্ধুর গলায় এবার বলবেন, স্যার, ছাড় দেয়া কম দামি জুতোগুলো আমাদের ওই দিকে রয়েছে। তার অঙ্গভঙ্গিতে ফুটে উঠবে নিষিদ্ধ কোনো পণ্য বিক্রির রহস্যময় অভিব্যক্তি।

তবে মহাশয় যেদিকটা দেখাবেন তা আপনি প্রবেশকালেই পার হয়ে এসেছেন (প্রায় সবক্ষেত্রে বিষয়টি এ ধরনেরই হয়ে থাকে)। দেখবেন, বাম বা ডান দিকে যেখানে সহজে চোখ যায় না সেরকম স্বল্প আলোর স্থানে একটি বেঞ্চিতে বা মাঝারি টেবিলের ওপর কয়েক জোড়া জুতো রাখা আছে।

জুতোগুলোর ডিজাইন এবং টেম্পার অনেক আগেই যৌবনকাল ত্যাগ করেছে। অর্থাৎ ডিজাইন সেকেল, আর মানও ঝুরঝুরে। এখানে ঘষা, ওখানে চাপ খাওয়া। অনেক সময়ে এমন সব নমুনা সেখানে পাওয়া যায় যেগুলো দেখলে মনে হতে পারে রবার্ট ক্লাইভ বুঝি এই জুতো জোড়া পায়ে দিয়েই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ থেকে প্রথম ভারতভূমে অবতরণ করেছিল।

প্রিয় পাঠক, আপনার হয়তো বিশ্বাস হবে না, কিন্তু আমি অনেক বছর আগে এইরকম একটি পিস সংগ্রহ করেছিলাম নামি একটি জুতো কোম্পানির শো-রুম থেকে। জুতো দুটির নাকের দিকে বেশ মোটা আর চকচকে ইস্পাতের দুটি পাত্তি লাগানো ছিল। আমি পাদুকা জোড়টি কিনেছিলাম পায়ে দেওয়ার জন্য না, শুধু এটুকু বোঝার জন্য যে এই ‘মাল’ আসলো কোত্থেকে? যাদুঘর থেকে ভুলে চলে আসেনি তো?

সেই মন্দ কথাটা জানেন তো- বাঙালি মউজে আসলে মউতের কথা ভুলে যায়! আমিও বাঙালি এবং অজানা রহস্য উদঘাটনে শুধু আরবদেশীয় সিন্দাবাদই বিপদসংকুল সমুদ্রে জাহাজ ভাসাবে এমন তো হতে পারে না! বাঙালির ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা জয় করেছিল তার মর্যাদা রাখতে গিয়ে হলেও আমাকে কিছু একটা অন্তত করতে হবে। তাই রহস্য উদঘাটনের বাদশাহি নেশার ঘোরে চেপে বা সেলসপারসন-ম্যানেজারের চক্করে পড়ে এক দশক আগে সেই জুতো জোড়া ওই সময়ে দুই হাজার টাকায় কিনে এনেছিলাম- অন্য জরুরি প্রয়োজনের কথা ভুলে। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত ওই নমুনা দুটো ঘরে ছিল বাক্সবন্দি অবস্থায়- পড়ার সাহস বা রুচি কোনোটাই হয়নি অবশ্য কোনোদিন।

যাহোক, আসলে প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। ম্যানেজারের ওই অমন দৃষ্টির সামনে রীতিমতো সবুট প্যান্ট-শার্টে ঢেকে থেকেও আপনার নিজেকে দিগম্বর মনে হতে থাকবে এসময়। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, তাদের ওই সুকৌশলি মারপ্যাঁচে পড়ে নিজের অহমিকা ধরে রাখার ঝোঁকে অনেকেই পকেটে থাকা বেতনের সিংহভাগ দিয়ে ‘নিউ অ্যারাইভাল’ শু-স্যান্ডেল কিনে বাসায় ফিরেছে যার কোনো দরকারই ছিল না আপাতত। ওই জুতোর চেয়ে বরং তার সংসারে তখন দরকার ছিল ইলেক্ট্রিকের বিলটি পরিশোধ করে দেওয়া বা বাচ্চার জন্য এক টিন দুধ নিয়ে আসা।

হয়তো বলবেন, খদ্দের অমন কাণ্ড করতে যাবে কেন? তাকে কি জোর করেছে কেউ? কুকুর তাড়া করেছিল? নাকি হাত-পা বাঁধা ছিল তার?

জ্বী না, কুকুরও দৌড়ায় নাই এবং সবই খোলা ছিল ক্রেতার। কিন্তু সেই খোলা হাত-পা-বিচার বুদ্ধিকে প্রলোভন আর ধোঁকার পেরেক ঠুঁকে আগেই অসহায়ত্বের দেয়ালে আটকে রাখা হয়েছে জনাব। সুচতুর বেনিয়া কূটবুদ্ধিওয়ালা বেওসাদাররা এইসব ভালই জানেন। তারা জানেন, তাদের ওইসব নাটুকেপনার মুখে কাস্টমারের ইগোটা জেগে ওঠে অন্য সবার মতোই। ওই সময়ে সে ‘দু-টাকার’ সেলসম্যানকে একটু দেখিয়ে দেওয়ার জোশে যা ইচ্ছা তাই করে ফেলতে চায়। কিন্তু আসল অপকর্মটার জন্য দায়ী কিন্তু বেতনভোগী সেলসম্যান নন, দায়ী তার নিয়োগকর্তা ‘কাবুলিওয়ালা’।

স্বাভাবিক বুদ্ধিতে মানুষ কাবুলিওয়ালা স্বভাবের ব্যবসায়ীর ধোঁকায় পড়বে না এটা জানা কথা। কিন্তু ভেতো বাঙালিকে ওই তেঁতো বিষটোপই গিলিয়ে ছাড়ে ধুরন্ধর ব্যবসায়ী ও তার বেতনভোগী কর্মচারী যার তুলনা করা যায় লেখার শুরুর গল্পটিতে। বাঙালি ক্রেতা যেহেতু স্বেচ্ছায় বিষ খেতে চাইবে না তাই তাকে ৩০ থেকে ৯০% ছাড়ের লোভ দেখিয়ে শেষে বাঁশটা দেওয়া হয়। সেই বিষের ক্রিয়ায় তার ভোক্তা হিসেবে আত্মবিশ্বাসটি মারা যায়। শরীরে ফুটে ওঠে লোভের বিষপানে বাধ্য করতে দোকানদারের করা কৌশলী আঘাতের চিহ্নগুলো।

আর মূল্য হ্রাস করার কথা বলা হয় যেসব পণ্যে সেগুলোতেও দেখা যায় প্রথমে দুই গুণ দাম বাড়িয়ে তারপর ৫০% ছাড়ের স্টিকার নতুন করে লাগানো হয়- এর প্রমাণ অনেক পাওয়া গেছে। অথচ ইউরোপ-আমেরিকা না হয় বাদই দিলাম, মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়ার অপরাপর দেশগুলোতেও মূল্য হ্রাস মানে মূল্যহ্রাস, অন্য কোনো ফাঁকিঝুকি ধোঁকাবাজি থাকে না তাতে।

সেসব দেশে মূল্যহ্রাস চলাকালীন স্টক থাকা পর্যন্ত ওই পণ্য হ্রাসকৃত মূল্যে গ্রাহককে দিতে বাধ্য থাকে দোকানদার। আমাদের এখানে এমনও দেখা যায় যে ক্রেতা কোনো পণ্য নিয়ে মূল্য পরিশোধ করতে যাওয়ার পর হঠাৎ ম্যানেজার বা সেলসম্যান জিভে কামড় দিয়ে বলে ওঠেন, সরি স্যার। এটার দামে ভুল হয়েছে একটু। ভুল স্টিকার লাগানো হয়েছে। এর দাম আরো বেশি...

তবে এখন পর্যন্ত স্বস্তি এইটুকু যে আমাদের মুলুকের সব ব্যবাসাদাররাই তেল-পেঁয়াজ-চালসহ সব নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর জন্য কাফনচোর স্বভাবের হয়ে ওঠেননি। তাই এখনো মরে বেঁচে আছে এই বাঙালি। না হলে...

 

লেখক:

আহ্সান কবীর, সম্পাদক, দিনবদল বিডি।

২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:১৩পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।