• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দর টার্মিনালের সঙ্গে সুন্দর আচরণও জরুরি, না হলে সব বৃথা: প্রবাসী

সুন্দর টার্মিনালের সঙ্গে সুন্দর আচরণও জরুরি, না হলে সব বৃথা: প্রবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল উদ্বোধন হয়েছে সম্প্রতি। দৃষ্টিনন্দন ও চোখ ধাঁধানো নতুন এই টার্মিনালে অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা পাবে বিমান যাত্রীরা। তবে বিদেশগমনেচ্ছু প্রবাসী ও সাধারণ যাত্রীদের আশঙ্কাও রয়েছে নতুন টার্মিনাল নিয়ে। নতুন এই টার্মিনালে যেন অকারণে প্রবাসীদের হয়রানি ও যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে না হয়, সেই কামনা সেবাপ্রার্থীদের। এমন প্রত্যাশা করে মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১১ টায় (সৌদি সময়) এক সৌদি প্রবাসী তার ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন।

তোফায়েল আহমেদ নামের ওই প্রবাসীর ফেসবুক পোস্টটি আমরাই বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-

‘সুন্দর আচরণ শিখতে হবে, অন্যথায় সকল অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে’

আমি প্রবাসী, প্রতিনিয়ত যাতায়াত করতে হয় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে। তাই অসংখ্য তিক্ত অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতির শিকার হয়েছি ঢাকা এয়ারপোর্টে। যা লিখলে পুরো একটি বই ছাপানো যাবে। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিমানের প্রত্যেকটি সার্ভিস কর্মীদের জানা উচিত আমরা প্রবাসী, আমরা ভিসাসহ সকল কার্যক্রম শেষ করে এয়ারপোর্টে আসি। আমরা বিদেশ থেকে ছুটিতে দেশে যাই, ছুটি কাটিয়ে আবারো প্রবাসে ফিরে আসি।

‘আর এই সকল কার্যক্রমগুলো পরিচালনার জন্য সঠিক ডকুমেন্ট থাকে, তারপরও অসংখ্য হয়রানি, অযৌক্তিক, অশোভন আচরণ আমাদের সাথে করা হয়। তার কয়েকটা চিত্রের মধ্যে একটি ঘটনা হলো-

‘২০১৪ সালে আমি সাত বছর প্রবাসী জীবন অতিবাহিত করে প্রথম বারের মতো বাংলাদেশে ছুটিতে যাই। জেদ্দা এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন লাইন শেষ করে ইমিগ্রেশন অফিসারকে পাসপোর্ট দিতে সে আমার পাসপোর্টটা দেখে মুচকি হাসিতে বলে- মাশাল্লাহ অনেক দিন পরে দেশে যাচ্ছিস ?
আমি হাসিমুখে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম।
ইমিগ্রেশন অফিসার আমার পাসপোর্টে সিল দিতে দিতে বলে- বিয়ে করেছিস?
আমি লজ্জা মুখে মাথা নেড়ে না সূচক ইঙ্গিত করলাম।
এবার সে বলেন দেশে গিয়ে বিয়ে করবি?
আমি আবারো লজ্জা লজ্জা চেহারায় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম।
ইমিগ্রেশন অফিসার আমার পাসপোর্টটা হাতে দিয়ে বললেন, বিয়ের জন্য তোকে অগ্রিম অভিনন্দন।

এরপর সেই বিমান ঢাকায় অবতরন করা শুরু করলেই মনের ভেতর কেমন যেন সুপ্ত এক সুখানুভূতি শুরু হলো আমার। তর যেন সইছে না, কখন দেশের মাটিতে পা রাখবো, আর শীতল করবো আমার হৃদয়। অবশেষে বিমান অবতরণ করল। মনে হল জানলা দিয়ে লাফ দিয়ে নেমে পড়ি, আর দেশের মাটিতে বুকটা মিলাই।

ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বিমানের দরজায় আসতেই, আমার দেশের আকাশ, বাতাস ও শীতল হাওয়া আমাকে স্বাগত জানালো। তারপর হাঁটতে হাঁটতে ইমিগ্রেশন ডেক্সে এসে লাইনে দাঁড়ালাম। অবশেষে আমার সিরিয়াল এলো। ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে, পাসপোর্ট দিলাম। ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে বলে পাসপোর্ট নতুন কেন?
বললাম, জেদ্দা কনস্যুলেট থেকে বানিয়েছি।
ইমিগ্রেশন অফিসার, কত বছর বিদেশ ছিলেন?
বললাম, সাত বছর।
ইমিগ্রেশন অফিসার, এত বছর দেশে আসেননি কেন?
বললাম, স্যার গরিব মানুষ কাজ করেছি, তাছাড়া সৌদি গিয়ে এক বছর পরেই অবৈধ হয়ে গিয়েছিলাম। গত বছর সৌদি সরকার অবৈধদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দিলে পাসপোর্ট বানিয়ে বৈধ হয়েছি। তাই আমার এখন নতুন পাসপোর্ট।

ইমিগ্রেশন অফিসার নাম জানতে চাইলেন।
আমি, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর নাম বললাম। এরপর সে আমার ঠিকানা, গ্রাম, উপজেলা, জেলা সব জিজ্ঞেস করল। খুব বিরক্ত লাগছিল। তারপরও দেশের বাড়িতে ফিরবো ভেবে চুপ করে সব সহ্য করে গেলাম। সব শেষ করে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আসলাম।

‘ছয় মাস ছুটি কাটিয়ে সৌদি চলে যাবার পালা। ঢাকার বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট দিতেই শুরু হলো সেই লাগাতার প্রশ্ন। তবে এবার একটু সাহস করে বলে ফেললাম, স্যার আমি দেশে ছুটিতে এসেছিলাম। আমার কাছে এক্সিট রিএন্ট্রি পেপার আছে, তাহলে কেন এতো প্রশ্ন করছেন?
ইমিগ্রেশন অফিসার বললেন, যা জিজ্ঞেস করছি ঠিকঠাক মতো বলুন, না হয় ঢুকতে দিব না।
আমি চুপ হয়ে গেলাম। ভেতরে ভয় শুরু হয়ে গেল। যা যা প্রশ্ন করলো, চুপচাপ উত্তর দিয়ে গেলাম চাকরির ভাইভার মতো।
অবশেষে বিমানে ওঠার আগে আরেকটা ঘটনা ঘটে গেল। সেখানে ক্লিনার টাইপের একটা লোক সকল যাত্রীর টিকেট চেক করা শুরু করলেন। আর একেক জনকে একেক রকম প্রশ্ন করছে, হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে লোকটি যাত্রীদের ইন্টারভিউ নিচ্ছে।
প্রশ্নগুলো এমন যে, আপনি কোথায় যাবেন? জেদ্দায়? জেদ্দা থেকে কোথায় যাবেন? খামছা মিয়া আসার কত?
এমনকি সেই লোকটি আমাদের আরবি ভাষাও চেক করলো।
এক যাত্রী বললেন, জেদ্দা থেকে অন্য শহরে যাবো। লোকটি বললেন, অন্য শহরে গেলে আপনি জেদ্দায় যাচ্ছেন কেন? এই বিমানে যাচ্ছেন কেন?

এমন অবস্থা দেখে কেতাদুরস্ত এক যাত্রী ক্ষেপে গেলেন। যাত্রীটির পোশাক পরিচ্ছদ দেখে মনে হলো তিনি সরকারি কর্মকর্তা। ওই লোকটি বিমানের ওই লোকটিকে বললেন, আপনি যাত্রীদের হয়রানি করছেন কেন? সেখানে পরিস্থিতিটা একটু গন্ডগোল মতো হয়ে গেল। পরে বিমান কর্মকর্তারা এসে ওই যাত্রীকে (সরকারি কর্মকর্তা) বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করলেন। বিমানের সেই প্রশ্নকারী লোকটিকে দিয়ে মাফ চাওয়ালেন।

জেদ্দায় পৌঁছে আমি সেই অফিসারকে বাইরে পেয়ে ধন্যবাদ জানালাম।
তিনি আমাকে বললেন, আপনারা প্রতিবাদ করেন না কেন?
বললাম, স্যার আমরা গরিব মানুষ। কাজ করতে বিদেশে যাই। সময়মতো কর্মক্ষেত্রে না এলে ভিসা হারাবো। তাই আর বিমানবন্দরে কোনো ঝামেলায় জড়ানোর সাহস দেখায় না।
বললাম, আপনি অফিসার মানুষ, আপনি না গেলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ক্ষতি হবে। কিন্তু আমরা সময়মতো প্রবাসে পৌছাতে না পারলে আমাদের পরিবার-সংসার সব শেষ হয়ে যাবে।

অফিসারটি আমার কাঁধে ও পিঠ চাপড়ে বললেন, ভালো থাকবেন। এরপর তিনি গাড়িতে উঠে চলে গেলেন।

‘এত বছর পর বিমানবন্দরের এমন হয়রানির ঘটনা কেন লিখলাম সেটার কারণ আছে। কারণ হচ্ছে, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে বাংলাদেশ থার্ড টার্মিনাল বানিয়েছে। দেখতে সুন্দর ও দারুণ এক টার্মিনাল হয়েছে। এটি আমাদের জন্য গর্বের। কিন্তু একজন প্রবাসী হিসেবে আমার চাওয়া হচ্ছে, এত সুন্দর একটা টার্মিনাল বা বিমানবন্দর যেন তার কর্মীদের ব্যবহার ও আচরণের কারণে অসুন্দর হয়ে না যায়। বিমানবন্দর কর্মীদের সুন্দর আচরণ ও হয়রানিমুক্ত সেবাদান নতুন বিমানবন্দর টার্মিনালকে আরও সুন্দর করবে। এটাই আমাদের কাম্য। ভালো থাকুক বাংলাদেশ, ভালো থাকুক আমার দেশের মানুষ। আমরা প্রবাসী, আমরা আমাদের দেশকে খুব ভালোবাসি।

বিঃদ্রঃ পাঠকদের সুবিধার্থে ফেসবুক পোস্ট আংশিক পরিমার্জন ও সংযোজন করা হয়েছে।

১৮ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:৩৩পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।