• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তালেবানের সঙ্গে সখ্যতা নাকি বৈরিতা: বিশ্ব মোড়লরা কী চায়

তালেবানের সঙ্গে সখ্যতা নাকি বৈরিতা: বিশ্ব মোড়লরা কী চায়

শাহজাহান নবীন

অবশেষে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসনের তড়িত সিদ্ধান্ত ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেছিলেন, আফগানিস্তানে শান্তি বজায় রাখতে ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যায়ক্রমে আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো জোটের সেনা প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু ততদিনে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পাদিত চুক্তির বেড়াজালে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

যে কারণে তালেবানের সঙ্গে ট্রাম্প সরকার সম্পাদিত চুক্তি পালন না করে বাইডেন প্রশাসনের কোনও উপায় ছিল না। এছাড়া তালেবানের পক্ষ থেকে চুক্তি কার্যকর করার ব্যাপারে হুমকিও ছিল। তালেবান বাইডেনের ঢিলেমি দেখে হুমকির সুরেই কথা বলেছে গত কয়েক মাস ধরে। দোহা, বেইজিং ও মস্কোতেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে তালেবান।

এসব বৈঠকে আফগানিস্তান থেকে দ্রুত সেনা প্রত্যাহারের শর্ত পূরণ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে তাগাদা দিয়েছে তালেবান। যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেকাতে যেমনি কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে তালেবান, তেমনি মার্কিন মদদপুষ্ট আফগান সরকারকে দমিয়ে রাখতে তালেবান দেশটির মাঠে ময়দানে সক্রিয় ছিল। ২০০১ সালের পর থেকেই তালেবান নানা ভাবে আফগানিস্তানে নিজেদের শক্তি দেখিয়ে এসেছে।

তবে বর্তমানে তালেবান অতিতের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। কারণ রাশিয়া, চীন, ইরান ও পাকিস্তানের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সহযোগিতা পাচ্ছে আফগানিস্তানের অন্যতম রাজনৈতিক পক্ষটি। দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পাকিস্তানের প্রভাব বরাবরই উল্লেখ করার মতো। কিন্তু ২০০১ সালের পর থেকে আফগানিস্তানে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ শুরু হওয়ায় ভারত সেখানে জেঁকে বসেছিল। আফগানিস্তানের অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়াঙ্গনে ভারত তাদের প্রভাব বিস্তার করেছিল। এমনকি আফগানিস্তানে অবস্থিত ভারতীয় কনস্যূলেট থেকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন বিদ্রোহে মদদ দেয়ার অভিযোগও করেছে পাকিস্তান।

পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে সৃষ্ট পশতু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয় তেহরিক ই তালেবান (টিটিপি) আফগানিস্তানেই প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পাকিস্তান সরকার বারবার এধরণের অভিযোগ করেছে। ভারত সরকার ইসলামাবাদের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তলে তলে আফগান সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে ভারত। আফগান সরকারের আস্থাভাজন বিনিয়োগকারী দেশ হিসেবে ভারত দেশটিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে। ভারত হয়তো চেয়েছিল, আফগানিস্তান হাতে থাকলে মধ্য এশিয়া ও আরব রাষ্ট্রগুলোতে বাণিজ্য বৃদ্ধি করা যাবে। একই সঙ্গে আফগানিস্তান হাতে থাকা মানে চীন ও পাকিস্তানকে উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকেও শাসানো যাবে। ভারতের এই ভাবনা সবারই জানা।

আর এসব সমীকরণ মাথায় রেখেই আফগান সরকারের ব্যাপারে চীন-পাকিস্তানের অসন্তোষ ছিল। গত দুই দশকে চীন ও পাকিস্তান আফগানিস্তানের তালেবানকে রাশিয়া ও ইরানের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া নিজেদের ভূ-নিরাপত্তার স্বার্থে রাশিয়া ও ইরানও চেয়েছে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট বিদায় হোক। আর তাদের এই চাওয়া পুরণ করার জন্য আফগানিস্তানে দরকার ছিল একটি রাজনৈতিক পক্ষ, যারা দেশটির সরকারকে টেক্কা দিতে পারবে। সেই ভাবনা থেকেই চীন, রাশিয়া, ইরান ও পাকিস্তান তলে তলে একজোট হয়ে তালেবানকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এসেছে। যার ফল হিসেবে এখন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এতে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের মান যাচ্ছে, কিন্তু এর বড় ভুক্তভোগী হতে যাচ্ছে হয়তো ভারত।

আফগানিস্তানে কী চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র: ৯/১১ এ সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ বিরোধী বৈশি^ক দমননীতি হাতে নিয়েছিল। তারই অংশ হিসেবে ২০০১ সালে আফগানিস্তানে তালেবানের শেলটারে থাকা আল কায়েদা উৎখাতে অভিযান চালায় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিনীদের হামলা ও ন্যাটো জোটের অভিযানে ২০০১ সালের শেষের দিকে আফগানিস্তানের ক্ষমতা হারায় তালেবান। অনেক শীর্ষ নেতা বন্দী ও নিহত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশনে সংবিধান পরিবর্তন করে আফগানিস্তানে রাষ্ট্রপতির শাসন চালু করা হয়। এরপর একের পর মার্কিন ছায়া শাসন আফগানিস্তানে কাজ করে গেছে। কিন্তু তালেবান গত ২০ বছরের একটি দিনও মার্কিন বাহিনী ও আফগান সরকারকে শান্তিতে ঘুমোতে দেয়নি।

রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও ইরানের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সহযোগিতায় দিনেদিনে তালেবান আরও শক্তি অর্জন করেছে। শেষমেষ উপায়ন্তর না পেয়ে আফগানিস্তান ছেড়ে যেতেই বাধ্য হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন বাহিনীর আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়াকে নিজেদের বিরাট বিজয় হিসেবে দাবি করেছে তালেবান। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরাও এমনটাই বলছেন।

তবে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়া মানেই যে তালেবানের জয়, তা এখনই বলা কঠিন। নতুন করে নতুন কোন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছাড়ল কিনা তার ওপর সুক্ষ্ম দৃষ্টি রেখেছে চীন-রাশিয়া-ইরান ও পাকিস্তান। কারণ এই অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান মানেই চীন-রাশিয়া-ইরানের ওপর থেকে চাপ কমে যাওয়া। এতোদিন এই তিন রাষ্ট্র এটাই চেয়ে এসেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র আফগান ছাড়ুক। এই চাওয়া থেকেই তারা আফগান তালেবানকে সহায়তা দিয়ে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই আফগান ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘরমুখী হওয়া নতুন কোন পরিকল্পনার অংশ কিনা তা এখন ভাবনার বিষয়। কারণ মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশগুলোতে বেশ কয়েকটি জঙ্গী সংগঠন এখনও সক্রিয়। সিরিয়া, ইরাক ও লেবানন ও সংলগ্ন এলাকাগুলোতে আইএস, আইএস খোরাসানসহ বেশ কয়েকটি জঙ্গী সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। চীন, রাশিয়া, ইরান ও পাকিস্তান বরাবরই এই সংগঠনগুলোকে মার্কিনিদের মদদপুষ্ট তুরুপের তাস হিসেবে আখ্যা দিয়ে আসছে। সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে লড়ছে রাশিয়া ও বাশার আল আসাদের সরকার। এবার এই চার দেশের সঙ্গে তালেবানও একই সুরে কথা বলছে। কাজেই তৃতীয়পক্ষ ব্যবহার করে আফগানিস্তান ও সংলগ্ন অঞ্চলে ছড়ি ঘুরাতে চাইলেই তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখন কঠিনই হবে।

বিবিসি, সিএনএনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গত কয়েকমাস ধরে এসব নিয়ে লাগাতার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সোভিয়েত হটাতে একসময় তালেবানের সঙ্গে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আজ সেই যুক্তরাষ্ট্রই তালেবানের প্রধান শত্রু, আর রাশিয়া (সাবেক সোভিয়েত) এখন বন্ধু। বিবিসির প্রধান বৈদেশিক সংবাদদাতা লিস ডুসেট ১৯৮৯ সালে সোভিয়েতের আফগানিস্তান ছাড়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন, কীভাবে তালেবানকে সহযোগিতা দিয়ে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত হটানো হয়েছিল।

এই যে সরকার বসানো বা তালেবান হটানোর যে ঘটনাপ্রবাহ, এর নেপথ্যের রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণ। সেগুলো মিডিয়াতে খুব একটা উঠে আসে না। যা আসে সেটাও কাটা কাটা।

খনিজ সম্পদ: আফগানিস্তানে মাটির নিচে রয়েছে তিন ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের খনিজ সম্পদ। যা মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। উত্তোলনযোগ্য এসব খনিজ সব দেশে পাওয়া যায় না। আফগানিস্তান চাইলে বছরের পর এই খনিজ সম্পদ বিক্রি করে অনায়াসে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে। এই খনিজ সম্পদের ভবিষ্যত বাজারমূল্য বিবেচনা করে আফগানিস্তানকে নতুন সৌদি আরব হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন অনেকেই। স্বর্ণ, নিকেল, লিথিয়াম ও কপারের সন্ধান মিলেছে দেশটিতে। মূলবান এসব খনিজ আগামীর তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বে ব্যাপক চাহিদা তৈরি করবে। এছাড়া আফগানিস্তানে স্ক্যান্ডিয়াম ও ইউটিরিয়ামসহ বহু দুর্লভ মৃত্তিকা মৌল পাওয়া গেছে, যা মোবাইল ফোন, টেলিভিশন ও ফাইবার অপটিক তৈরিতে ব্যাপক ভাবে ব্যবহার হয়। তাহলে এটা সহজেই অনুমেয়, আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিতে রাশিয়া, চীন, ইরান, পাকিস্তান কেন মরিয়া।

যদিও এরই মধ্যে আফগানিস্তানে রেল প্রকল্পসহ বেশকিছু প্রকল্পে কাজ শুরু করেছে চীন। বেইজিং এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানে কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখিন হয়নি। এর পেছনে অবশ্য তালেবানের প্রভাব রয়েছে। কিন্তু একই সময়ে ভারত প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি ডলারের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বারবার বিপাকে পড়েছে। আফগানিস্তানের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো খাতে ভারত প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। দিলারাম-জারাঞ্জ মহাসড়ক নামে ২১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি মহাসড়ক নির্মাণ করেছে ভারত। এছাড়া নতুন আফগান পার্লামেন্ট ভবনও নির্মাণ করে দিয়েছে দিল্লি সরকার। কিন্তু তারপরও আফগানিস্তানে ভারতের স্থায়ীত্ব এখন হুমকির মুখে। আফগান সরকারের সহায়তায় ভারতীয় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে। যা তালেবানের কাছে সুখকর ছিল না।

তাই মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে ভারতের অবস্থানও নড়বড়ে হয়ে গেছে। ভারতীয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দিশেহারা। গত দুই দশকে আফগানিস্তানে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল ভারত। কিন্তু সেটা যে এত অল্প সময়ে ভেঙে পড়বে তা হয়তো দিল্লি ঠাহর করতে পারেনি।

এদিকে গত সপ্তাহে দেশটির হেরাথ প্রদেশে ৩০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত ভারত-আফগানিস্তান মৈত্রী ড্যামে হামলা চালিয়েছে তালেবান। হামলায় ১০ জন নিরাপত্তাপ্রহরী নিহত হয়েছেন। এই হামলা ভারতের জন্য তালেবানের পক্ষ থেকে অবশ্যই একটি নির্মম বার্তা।

চীন রাশিয়া পাকিস্তান ইরান সমীকরণ: যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ঐক্য। বিশেষ করে আফগানিস্তানে মার্কিন মদদপুষ্ট সরকারকে কোনও সহযোগিতা দেয়নি রাশিয়া, ইরান, চীন ও পাকিস্তান। উপরন্তু ২০ বছর আগে মার্কিন অভিযানে ক্ষমতা হারানো তালেবানকে আফগানিস্তানের প্রতিবেশী এই চার রাষ্ট্র সহযোগিতা দিয়ে এসেছে। এখনও দিচ্ছে। কারণ এই চার রাষ্ট্র ‘শত্রুর শত্রু, আমাদের বন্ধু’ নীতিগ্রহণ করেছে।

বিবিসিতে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে সম্পতি। রাশিয়া, চীন, ইরান ও পাকিস্তান তাদের ভূ-নিরাপত্তার স্বার্থে সবসময় চেয়েছে এ অঞ্চল থেকে মার্কিন আনাগোনা দূর হোক। তাই তারা মনেপ্রাণে, কূটনৈতিক টেবিল থেকে মাঠে ময়দানে আফগানিস্তান ইস্যূতে বারবার যুক্তরাষ্ট্রকে কোণঠাসা করেছে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্লাটফর্মে চীন, রাশিয়া, ইরান বারবার আফগানিস্তানে মার্কিন উপস্থিতি অবসানে কথা বলেছে। আর শেষ দিকে চীন, রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে যোগ দিয়েছে পাকিস্তান। এতে করে তাদের শক্তি আরও বেড়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তান তালেবানের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। যদিও শুরু থেকেই তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তান সরকার ও তাদের গোয়েন্দাদের যোগাযোগ ছিল। তবে কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে তালেবানের শান্তিচুক্তিকালীন পাকিস্তানী কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ সবার নজরে এসেছে। অবশ্য তালেবানের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে পাকিস্তান এখন আর লুকোচুরিও করে না। তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের হট কানেকশান থাকায়, চীন, রাশিয়া ও ইরান পাকিস্তানকে মধ্যস্ততায় রেখে তালেবানের কাছে পৌছেছে। এবং তারা এখন পর্যন্ত সফল বলা যায়।

ভারত কী চায়: আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায় হয়তো মার্কিনীদের মাথা নিচু করে দিয়েছে। কিন্তু মার্কিন বাহিনীর আফগান ছেড়ে যাওয়ায় ভারতের আশা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। কারণ আফগান সরকারের সঙ্গে ভারত গত দুই দশকে একক ভাবেই সম্পর্ক বহুদুর নিয়ে গিয়েছিল। আফগানিস্তানের সামাজিক, অর্থনৈতিক, অবকাঠামো, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া খাতে ভারত প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া চিরবৈরি পাকিস্তান ও চীনের ওপর ভূরাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের জন্য আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল ভারত। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের বিদ্রোহে আফগানিস্তানে অবস্থিত ভারতীয় কনস্যূলেটের ইন্ধন ছিল বলে বারবার পাকিস্তান অভিযোগ দিয়েছে। এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে ভারত। কিন্তু অভিযোগ করলে বা অভিযোগ অস্বীকার করলেই কী সব কিছু শেষ হয়ে যায়? যায় না। যাইহোক, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের খবরে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে ভারত সরকার। এরই মধ্যে আফগানিস্তানের ৭০ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান। আফগান সরকারের হাতে আছে শুধু কাবুল। সেটাও কখন হাত ছাড়া হবে বলা যায় না।

এসব ভাবগতি বুঝে এরই মধ্যে আফগানিস্তানের হেরাথ ও কান্দাহার প্রদেশের ভারতীয় কনস্যূলেট বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বিশেষ বিমানে ভারতে আনা হয়েছে। এছাড়া গত দুই দশকে ভারতীয় বিনিয়োগ স্থাপনাগুলোতে একাধিক হামলা চালিয়েছে তালেবান।

ভারতীয় আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. সঞ্জয় ভরদ্দাজ সম্প্রতি বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘বৃহত্তর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অভিলাষ, অভ্যন্তরীণ এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য ভারতের কাছে আফগানিস্তান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধ্য এশিয়ার বাজারে ঢুকতে হলে ভারতকে অবশ্যই আফগানিস্তানে শেকড় বিছাতে হবে। ভারত সেই পাইপলাইন তৈরির কাজ এগিয়েও নিয়েছিল। এছাড়া লাদাখ ও কাশ্মির নিয়ে চীন-পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে দিল্লির, এর ওপর যদি আফগানিস্তান হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হতেই পারে।’

এখন প্রশ্ন হলো, ভারত কি তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো করে আফগান ছেড়ে দিয়ে চলে আসবে? মোটেই না। দিল্লি এরই মধ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দফায় দফায় কাতার ও মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন। তিনি এমন সময়ই কাতারে গিয়েছেন, যখন তালেবানের কূটনৈতিক শাখার শীর্ষস্থানীয়রা দোহায় অবস্থান করছিলেন। কাজেই এটা ধারণা করা যেতেই পারে, ভারত সরকার তালেবানের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছে। আর সেটা যদি হয়েই যায়, তবও অবাক হওয়ার কারণ নেই। তবে ভারতের এই পথচলা অতটা সহজ হবে না, পাকিস্তান তা সহজ হতে দেবে না। কারণ তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের নাড়ির সম্পর্ক। অতিতে পাকিস্তানের প্রেসক্রিপনে ভারতীয় স্বার্থে হামলাও চালিয়েছে তালেবান। সেই তালেবান আজ হুট করেই ভারতের সঙ্গে পথ চলবে, এটা ভাবতে হলে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

পাকিস্তান কী চায়: ভূরাজনীতির মারপ্যাঁচে আফগানিস্তান এখন হটকেক। মধ্য এশিয়া ও আরব রাষ্ট্রগুলোতে বাণিজ্য বৃদ্ধি, সহজ যোগাযোগ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় আফগানিস্তান হতে পারে কলের কাঠি। ২০০১ সালের পর থেকে মার্কিন নিয়ন্ত্রণের কারণে পাকিস্তান আফাগানিস্তানে কোনও প্রভাব খাটাতে পারেনি। কারণ পাকিস্তান বরাবর তালেবানকে সমর্থন দিয়েছে। বহু তালেবান যোদ্ধা ও রাজনীতিক পাকিস্তানে বছরের পর বছর আশ্রয় পেয়েছেন। তাই পাকিস্তান চাইবে, তালেবান আবারও কাবুলের মসনদে ফিরে আসুক। এতে করে আফগানিস্তানে মার্কিন-ভারতের কর্তৃত্ব যেমন শেষ হবে, তেমনি পাকিস্তানের আধিপত্য বৃদ্ধি পাবে। যে কারণে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাপ্রত্যাহার ও মার্কিনীদের সঙ্গে তালেবানের নানা বৈঠকে কূটনৈতিক সহযোগিতা দিয়েছে পাকিস্তান সরকার। দোহা, বেইজিং ও মস্কোতে অনুষ্ঠিত তালেবান-যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বৈঠক কে ঘিরে পাকিস্তানি কূটনীতিকদের তৎপরতা সবাই দেখেছে।

এছাড়া আফগানিস্তানে তালেবান অধ্যূষিত এলাকায় চীনা বিনিয়োগের অন্যতম চাঁবিকাঠি পাকিস্তান। তালেবান চীনের কাছ থেকে চাঁদা পেয়েছে, নিজেদের অঞ্চলের উন্নয়নও পেয়েছে। কাজেই তালেবান ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে পাকিস্তানের অবদান দুই পক্ষই স্মরণ রাখবে বলে মনে হয়। এসব হিসেবে নিকেশ ছাড়াও পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানের বহু পুরনো দোস্তি আছে। বেলুচিস্তানে পশতু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও আফগানিস্তানের পশতু জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা পাকিস্তান ও তালেবানের জন্য খুবই বিব্রতকর। যে কারণে দুই পক্ষই চায়, বেলুচ ও সংশ্লিষ্ট আফগান অঞ্চলে শান্তি বজায় থাক। আর তাই তালেবান ও পাকিস্তানের দুই পথে হাঁটার সম্ভাবনা খুবই কম।

সম্প্রতি তালেবানের মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ তুর্কি মিডিয়ায় দেয়া বক্তব্যে জানিয়েছে, পাকিস্তান তালেবানের দ্বিতীয় আবাসস্থল। তিনি এটাও বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশগুলোতে জঙ্গী গোষ্ঠী আইএসকে দমন করা হবে। জবিউল্লাহ বলেছেন, ‘পাকিস্তান আমাদের লাখ লাখ শরনার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, খাবার দিয়েছে। আমরা পাকিস্তানের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এও বলেছেন, আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার সুযোগ দেয়া হবে না।’

তালেবান মুখপাতের এই রাখঢাকহীন কথাই প্রমাণ করে তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের দহরম মহরম কোন পর্যায়ে পৌছেছে। আর সামনে যদি তালেবান আফগানিস্তানের মসনদে আসীন হয়, তাহলে পাকিস্তানের যে ‘পোয়া বারো’ তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

ঘুরে দাড়ানোর আফগান স্টাইল কেমন হবে: দীর্ঘ ২০ বছরের যুদ্ধ শেষে আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ন্যাটো জোট। এ মাসের প্রথম দিকে কোনও ঘোষণা ছাড়াই আফগানিস্তানের বাগরাম সেনা ঘাঁটি ছেড়ে গেছে মার্কিন বাহিনী। এই বাগরাম ঘাঁটি নির্মাণ করেছিল সোভিয়েতরা (রাশিয়া)। আফগানিস্তান থেকে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েতের বিদায়ের পর এই ঘাঁটি বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। ২০০১ সালে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর বাগরাম ঘাঁটি সংস্কার করে মার্কিন সামরিক বাহিনী। এই ঘাঁটি থেকেই পুরো আফগানিস্তানে অভিযান ও যুদ্ধ পরিচালনা করেছে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী। আজ তারা আফগানিস্তান ছেড়ে বিদায় হয়েছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা আফগানিস্তান ত্যাগের পরপরই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছে, আগামী ছয় মাসের মধ্যে আফগান সরকার ক্ষমতা হারাবে। সিআইএ’র এই বক্তব্য এটাই জানান দিচ্ছে যে, আফগানিস্তানের নেতৃত্ব যাচ্ছে তালেবানের হাতে। আর এটাই যদি হয়, তাহলে দেশটিতে নতুন করে গৃহযুদ্ধও শুরু হতে পারে।

তবে এরই মধ্যে আফগানিস্তানের ৭০ শতাংশ অংশ দখল করে নেয়া তালেবান দিয়েছে ভিন্ন বার্তা। তারা শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ আফগানিস্তান গড়ার ঘোষণা দিয়েছে। এরকম বার্তা মূলত ফরমাল বার্তাই বটে। মসনদে বসার পর তারা আসলেই কতটা মানবিক আফগানিস্তান গড়তে পারবে সেটাই দেখার বিষয়। তবে আফগানিস্তানে সরকার পরিচালনায় তালেবান যে আর অতিতের ভুল করবেনা সেটা অনুমান করা যায়। কারণ তালেবানের ওপরে এখন চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান ও ইরানের বিরাট প্রভাব বিরাজমান। তালেবান চাইলেই এই বলয় থেকে বের হতে পারবে না। এখন আফগানিস্তানের সাধারণ জনগোষ্ঠীর সমর্থন আদায় করাই হবে তালেবানের প্রথম চ্যালেঞ্জ। এই সমর্থন যদি তারা পেয়ে যায়, তাহলে তালেবান নতুন রূপেই প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে হয়তো।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আফগানিস্তানে ২০০১ সালের পর থেকে ন্যাটো জোট প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজের সন্ধান পেয়েছে। এই খনিজ সম্পদ উত্তোলনের চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন জোট। কারণ আফগানিস্তানের কাবুলসহ কয়েকটি শহর ন্যাটো জোটের হাতে থাকলেও দেশটির খনি এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল তালেবানের হাতে। যে কারণে দেশটির খনিজ সম্পদ এখনও আগের মতোই আছে। এখন কথা হচ্ছে, এই খনিজ সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও বাণিজ্যিকীকরণ করতে পারলে আফগানিস্তানে তালেবানের সমর্থন বাড়বে। অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হতে পারে। তবে শেষটা কেমন হবে, আফগান সরকার ও তালেবান কোন সমীকরণে এগিয়ে যাবে তা এখন দেখার বিষয়। সিআইএ যে ভবিষ্যতবাণী করেছে, তা যদি সত্যি হয়, তাহলে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ আফগানিস্তানের নেতৃত্ব তালেবানের হাতেই উঠছে। আর এ সব কিছুই হয়তো পরিকল্পনারই অংশ। যেই পরিকল্পনার মধ্যদিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙল না’ নীতি সফল হতে পারে। অথবা আফগানিস্তান হয়ে যেতে পারে নতুন ‘সিরিয়া’।

 

লেখক- নিউজরুম এডিটর, বাংলাদেশ টাইমস

 

১৫ জুলাই ২০২১, ১১:১৫পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।