• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শীতে খেজুর গুড়ের বাহারি পিঠাপুলি

শীতে খেজুর গুড়ের বাহারি পিঠাপুলি

ছবি- সংগৃহিত

ফিচার ডেস্ক

অগ্রহায়ণ পেরিয়ে পৌষের উঠোনে বাংলাদেশ। নতুন ধানের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামের বাতাসে। আবহমান কাল থেকে অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি থেকে নতুন ধান কাঁটা শুরু হয়। এরপর শুরু হয় নবান্ন উৎসব। বছরের এই সময়টাতে কৃষকের ঘরে থাকে নতুন চালের ভাত। আর নতুন চালের গুঁড়ো, নতুন খেজুর গুড় দিয়ে পিঠাপুলির আয়োজন। নবান্ন উৎসবের উপলক্ষ ছড়িয়ে যায় গ্রাম থেকে শহরে।

এ ছাড়া শীতকালের আবার খেঁজুর গাছের রস জ্বাল দিয়ে নতুন গুড়ও তৈরি হয়। বর্তমানে খেঁজুর গুড়ের বাণিজ্যিকীকরণে তা গ্রাম কিংবা শহর, সবখানেই পাওয়া যায়। আর নতুন গুড় ও নতুন চালের গুড়ো দিয়ে বাঙালি বধু, তনয়া, জননীরা বাড়িতেই বানিয়ে ফেলে নানা পদের পিঠাপুরি।

প্রিয় পাঠক, পিঠাপুলি নিয়ে শেষ পর্বে গ্রাম বাংলার শতবছরের ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলি নিয়ে কিছু তথ্য দেয়ার চেষ্টা করেছি। চলুন দেখে নেয়া যাক প্রথম পর্বে কি কি থাকছে।

চিংড়ি পাটিসাপটা: এই পিঠার নাম অনেকে প্রথম শুনে থাকতে পারেন। কিন্তু চট্টগ্রাম, বরিশাল, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় এই পিঠা খুবই জনপ্রিয়। এই পিঠা তৈরিতে প্রয়োজন ময়দা, চালের গুঁড়ো, লবন, ডিম, দুধ, মাখন, পনির, টুকরো করা চিংড়ি মাছ, পেঁয়াজ, ধনেপাতা এবং ভাজার জন্য তেল অথবা মাখন।

প্রস্তুত প্রনালি: কড়াই অথবা প্যানে অলিভ অয়েল গরম করতে হবে এবং পেঁয়াজগুলো তাতে ভাল করে ভাজতে হবে। মাখন এবং ময়দা মিশিয়ে একটা হালকা মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। এর পর দুধ দিয়ে ঘন না হওয়া পর্যন্ত সমানে নাড়তে হবে। এর পর আঁচ বাড়িয়ে দিয়ে তার মধ্যে পনিরের টুকরো, লবণ, ঝাল মরিচ, ধনেপাতা এবং চিংড়ি মাছগুলো দিয়ে দিতে হবে। ময়দা, চালের গুঁড়ো, এক টেবিল চামচ ধনেপাতা এবং একটু লবণ দিয়ে বাটিতে ভাল করে মেশাতে হবে। ডিম এবং দুধ মিশিয়ে একটা ঘন মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। এরপর প্যানে মাখনটা গরম করতে হবে ধোঁয়া ওঠা পর্যন্ত। প্যানে মিশ্রণের কিছুটা দিয়ে হাতা দিয়ে ঘুরিয়ে পাটিসাপটা-টা তৈরি করতে হবে। নিচের অংশে রং ধরা পর্যন্ত রান্না করতে হবে। ভাজাটাকে নাড়তে হবে এবং আরও কিছু সেকেন্ড ধরে রান্না করতে হবে। চিংড়ি মাছের মিশ্রণটা এর মধ্যে ভরে পরিবেশন করতে হবে।

তেলেভাজা পিঠা বা পাকান পিঠা: গ্রামাঞ্চল কিংবা শহর, সবখানেই এই পিঠা বেশি খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। মানুষ সহজেই এই পিঠা বানাতে পারে। এজন্য এই পিঠা পছন্দের তালিকায় হয়তো সহজেই উঠে এসেছে।

প্রস্তুত প্রনালী: চালের গুঁড়া, খেজুরের গুড়, আটা, তেল। খেজুরের গুড় আর এক গ্লাস পানি জ্বাল দিয়ে নিতে হবে। তারপর এতে চালের গুঁড়া ও আটা দিয়ে ঘন করে মিশাতে হবে। কড়াইতে তেল দিয়ে গরম হলে এক চামচ করে পিঠার গোলা ছেড়ে দিতে হবে। পিঠা ফুলে উঠলেই তৈরি হয়ে গেলো তেলেভাজা বা পাকান পিঠা।

সুন্দরী পাকান পিঠা: এটিও পাকান পিঠা। সুস্বাদু ও জনপ্রিয়। এটি তৈরিতে দুধ, নারকেল (কুরানো), ময়দা, লবণ, তেল, পানি, তেজপাতা এবং কয়েকটা দারচিনি প্রয়োজন হয়। এই উপাদানগুলো একসঙ্গে জ্বাল দিয়ে সিরা বানাতে হবে। দুধ জ্বাল দিয়ে ফুটে উঠলে মিহি বাটা নারকেল, লবণ ও ময়দা দিয়ে খামির তৈরি করতে হবে। ভাল করে মাখিয়ে পুরু করে বেলে বিস্কুট কাটার দিয়ে কেটে উপরে খেজুর কাঁটা অথবা ছুরি দিয়ে ডিজাইন করে সব পিঠা তৈরি করে ডুবোতেলে ভেজে সিরায় ডুবাতে হবে।

গোলাপফুল পিঠা: এটি নোয়াখালী, কুমিল্লা, ঢাকা, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পিঠা। অতিথি আপ্যায়নে গোলাপফুল পিঠার লা জবাব। এটি তৈরিতে দুধ, ময়দা, চিনি, লবণ, সামান্য ঘি প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া সিরা তৈরির জন্য চিনি এবং কয়েক টুকরো দারচিনি লাগে।

প্রস্তুত প্রনালি: দুধ গরম হলে চিনি, লবণ, ময়দা দিয়ে কাই করে নিতে হবে। পরে ঠান্ডা হলে অল্প অল্প করে ঘি দিয়ে ভালো করে মথে রুটি বেলে দুই ইঞ্চি ব্যাসে গোল গোল করে কেটে গোলাপ তৈরি করতে হবে। এবার গরম তেলে ভেজে সিরায় ডুবিয়ে নিতে হবে।

বিবিখানা পিঠা: এই পিঠা তৈরিতে প্রয়োজন চালের গুঁড়া, ঘি, গুড়া, গুড়, ডিম, নারকেল কোরানো, এলাচ গুঁড়া এবং পানি। এই পিঠা তৈরি করতে হলে প্রথমে চালের গুঁড়া শুকনো পাতিলে ভেজে নিতে হবে। গুড় পানিতে জ্বাল দিয়ে নিতে হবে। প্রথমে গুঁড়া দুধ আর ডিম ভালো করে মিশিয়ে চালের গুঁড়া মিলিয়ে নিয়ে সবশেষে নারকেল মিলিয়ে দিতে হবে। টিফিন বাটিতে ঘি ব্রাশ করে খামির ঢেলে এক ঘন্টা ভাপ দিন অথবা বেক করতে হবে।

কলার পিঠা: সৌখিন ও ভোজনরসিকদের কাচে কলার পিঠা অত্যন্ত প্রিয়। এটি তৈরিতে প্রয়োজন পাকা কলা, কাঠবাদাম গুঁড়া, লবণ, নারকেল কোরা, খেজুরের রস, সয়াবিন তেল (ভাজার জন্য), ঘি এবং চালের আটা। প্রথমে খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে কলা চটকে নিয়ে লবণ, কাঠবাদাম গুঁড়া, নারকেল কোরা, ঘি ও চালের আটা দিয়ে মাখিয়ে একটু ঘন গোলা তৈরি করে নিন। এরপর ডুবো তেলে ভেজে নিন। ভাজা কলার পিঠা রসে দিয়ে ১০-১৫ মিনিট পর পরিবেশন করা যায়।

ইলিশ পিঠা: ইলিশ মাছ নানা ভাবে খাওয়া হয়। কিন্তু পিঠা বানাতেও যে ইলিশ মাছ চলে তা হয়তো অনেকেই জানে না। ইলিশ পিঠা তৈরিতে প্রয়োজন ইলিশ মাছ, লবণ, টমেটো এবং পানি। এই পিঠা তৈরিতে প্রথমে মাছ আঁশ ফেলে মাথা লেজ কেটে ধুয়ে নিতে হবে। ২ কাপ পানি, টমেটো সস, লবণ ও মাছ একসঙ্গে দিয়ে সেদ্ধ করে পানি শুকিয়ে মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে নিতে হবে।

পুর: ২ কাপ মাছের কিমা, পেঁয়াজ কুচি ৩ কাপ, লবণ ১ চা চামচ, কাঁচামরিচ কুচি ১৫টা, ধনেপাতা কুচি আধা কাপ, তেল ৪ টেবিল চামচ। তেল গরম করে পেঁয়াজ হালকা বাদামি করে ভেজে তার মধ্যে মাছের কিমা, ধনিয়া পাতা, লবণ দিয়ে কষিয়ে পুর তৈরি করতে হবে।

এরপর চালের গুঁড়ো ১ কাপ, ময়দা ১ কাপ, পৌনে ১ কাপ পানি দিয়ে সেদ্ধ করে ময়ান করে ডিম্বাকার শেপে ৫ ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা রুটি তৈরি করে. রুটির একপাশে কিমা বিছিয়ে দুই পাশ রুটি কেটে ভাগ করে বেণির মতো বুনে মাছের আকার দিতে হবে ও তেলে ভাজতে হবে।

আনারস পিঠা: এই পিঠা তৈরিতে প্রয়োজন ময়দা আধা কেজি, তেল এক কেজি, গুড় এক কেজি, লবণ এক চামচ, পানি পরিমাণ মতো। ময়দা ও লবণ দিয়ে খামির করে পাতলা রুটি তৈরি করতে হবে। রুটি তৈরির পর তা চিকন করে কেটে নিতে হবে। তারপর কেটে নেওয়া রুটিগুলো একসঙ্গে রেখে একটির ওপর আরেকটি বুনে যেতে হবে। বুনন শেষে দুই মাথা একসঙ্গে জুড়ে দিতে হবে। তেলে বাদামি রঙ করে ভেজে গুড়ে পাক দিতে হবে।

চাপাতি পিঠা: এই পিঠা তৈরিতে প্রয়োজন আতপ চাল ১ কাপ পাঁচমিশালি ডাল (মুগ, মসুর, মটর, ছোলা, অড়হর) আধা কাপ ডিম (ইচ্ছা হলে) ১টি কাঁচা মরিচ কুচি ৪টি পোড়া শুকনা মরিচ কুচি ১টি লবণ স্বাদমতো চিনি ১ চা চামচ তেল সামান্য, চাল ও ডাল একসঙ্গে ভিজিয়ে রেখে বেটে নিতে হবে।

তারপর বাকি সব উপকরণ দিয়ে মেখে একটি গোলা তৈরি করতে হবে। এবার ননস্টিক ফ্রাই প্যানে সামান্য তেল দিয়ে তাতে দেড় হাতা করে গোলা দিয়ে ছড়িয়ে দিয়ে প্যান ঢেকে দিতে হবে। ৩-৪ মিনিট পর ঢাকনা তুলে নামাতে হবে। চাপতি পিঠা ভুনা মাংস বা নরম খেজুর গুড়েরর সঙ্গে পরিবেশন করা যায়।

নকশি পিঠা: নকশি পিঠা পছন্দ নয় এমন মানুষ পাওয়া ভার। মচমচে পিঠার অন্যতম নকশি পিঠা। এটি তৈরিতে প্রয়োজন চালের গুঁড়া ২ কাপ পানি দেড় কাপ লবণ সামান্য ঘি ১ টেবিল চামচ। সিরা- গুড় আধা কাপ চিনি ১ কাপ পানি ১ কাপ।

প্রস্তুত প্রনালি: প্রথমে পানিতে লবণ ও ঘি দিয়ে চুলায় দিতে হবে। ফুটে উঠলে চালের গুঁড়া দিয়ে সেদ্ধ করে কাই বানাতে হবে। পুরু করে রুটি বানিয়ে পছন্দমতো আকার দিয়ে কেটে নিয়ে খেজুর কাঁটা দিয়ে রুটিতে পছন্দমতো নকশা করে ডুবোতেলে ভাজতে হবে। সিরায় দিয়ে এপিঠ-ওপিঠ করে সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়ে নিতে হবে।

ফুলঝুরি পিঠা: সারাদেশেই এই পিঠা কমবেশি বানানো হয়। বিয়ে-সাদী কিংবা অতিথি আপ্যায়নে ফুলঝুরি পিঠা এখন বেশ চলে। এটি তৈরিতে প্রয়োজন চালের গুঁড়া ১ কাপ ডিম ১টি চিনি এক কাপের চার ভাগের তিন ভাগ লবণ সামান্য গরম পানি আধা কাপ তেল ভাজার জন্য এবং ফুলঝুরি নকশা ছাঁচ।

প্রস্তুত প্রনালি: চালের গুঁড়া, লবণ, চিনি দিয়ে গরম পানিতে এক ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। ডিম ফেটিয়ে চালের গুঁড়ার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হবে। তেল গরম করে ফুলঝুরি নকশা তিন-চার মিনিট তেলে ডুবিয়ে রেখে তুলে ফেলুন। তেল ঝরিয়ে আটার গোলার মধ্যে নকশা অর্ধেকের বেশি ডুবিয়ে নিয়ে আবার তেলের কড়াইয়ে এটি ডোবাতে হবে। পিঠা ফুলে ওঠামাত্রই ফুলঝুরির নকশা থেকে কাঠি দিয়ে আলাদা করে বাদামি রং হলে ভেজে তুলে রাখতে হবে।

তালের বড়া: আবহমান গ্রামীণ অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম অনুসঙ্গ তালের বড়া বা তালের পিঠা। এই পিঠা তৈরিতে প্রয়োজন আটা ২ কাপ, কনডেন্সড মিল্ক সিকি কাপ, গুঁড়া দুধ সিকি কাপ, খাওয়ার সোডা এক চিমটি, বেকিং পাউডার ১ টেবিল-চামচ, চিনি আধা কাপ, নারকেল আধা কাপ (কোরানো), লবণ ১ চা-চামচ, পানি ১ কাপ, তেল ভাজার জন্য পরিমাণমতো। সবগুলো উপকরণ একসঙ্গে মাখিয়ে আধা ঘণ্টা রেখে গোলা বানাতে হবে। এরপর ডুবোতেলে ভেজে নিলেই পিঠা হয়ে যাবে।

চিড়ার মোয়া: মচমচে ও সুস্বাদু চিড়ার মোয়া অনেকেরই পছন্দ। যারা শুকনো পিঠা খেতে পছন্দ করেন তাদের জন্য চিড়ার মোয়া। এটি তৈরিতে প্রয়োজন চিড়া ২৫০ গ্রাম, আখের গুড় ২ কাপ, ভাজা চালের ছাতু ২ টেবিল চামচ, নারকেল কোরা ১ কাপ, তেল ২ টেবিল চামচ।

প্রস্তুত প্রনালি: প্রথমে চিড়া তেলে ভেজে নিতে হবে। কড়াইয়ে গুড় দিয়ে তাতে সামান্য পানি দিয়ে জ্বাল দিতে হবে। গুড় আঠালো হলে তাতে ভাজা চিড়া, নারকেল ও ছাতু দিয়ে নাড়তে হবে। গুড় মিশে গেলে নামিয়ে ঠান্ডা হলে তৈরি করতে হবে মজাদার চিড়ার মোয়া।

মুড়ির মোয়া: চিড়ার মোয়ার মতই মুড়ির মোয়ার স্বাদ। তবে কিছুটা ভিন্নতা তো আছেই। এই মোয়া তৈরিতে লাগে মুড়ি ২০০ গ্রাম, খেজুরের গুড় বড় ২ কাপ। কড়াই চুলায় দিয়ে গুড় দিতে হবে। গুড় ফুটে উঠলে আস্তে আস্তে মুড়ি দিয়ে নাড়তে হবে। গুড় ও মুড়ি মিশে গেলে নামিয়ে সামান্য ঠান্ডা হলে হাত পানিতে ভিজিয়ে পছন্দমতো সাইজের মোয়া তৈরি করতে হবে। চলবে...

২৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০৩:২৪পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।