• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বই পাগল ছেলেটি এখন আইনের শিক্ষক

বই পাগল ছেলেটি এখন আইনের শিক্ষক

ছবি- সংগৃহিত

শাহজাহান নবীন

ছোটবেলা থেকেই বন-বনানীর প্রতি টান। স্কুল, বই-খাতার মোহ যাকে শৈশবে আকৃষ্ট করেনি। সুযোগ পেলেই তিনি বৃষ্টির কাদামাটিতে গড়াগড়ি খেতে পছন্দ করতেন। অন্য সবাই যখন বই-ব্যাগ কাধে নিয়ে স্কুলমুখী, আসাদুজ্জামান সাগর তখন পাখ-পাখালির গানে খুঁজে ফিরতেন কিঞ্চিত আনন্দ। প্রকৃতির প্রতি সফল এই মানুষটির টান এখনো অব্যাহত। সুযোগ পেলেই তিনি এখনো প্রকৃতির কাছে ছুটে যান। তবে প্রকৃতিপ্রেমী এই মানুষটি শৈশবে লেখাপড়ার প্রতি টান অনুভব না করলেও শিক্ষাজীবনে তিনি কৃতিত্বের অধিকারী।

ছাত্রজীবনে কখনো দ্বিতীয় না হওয়া আসাদুজ্জামান এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আইন পড়াচ্ছেন। তরুণ সফল ব্যক্তিত্বদের মধ্যে মো. আসাদুজ্জামান অন্যতম। আজকের এই পর্বে নিজের জীবনের নানা কথা তুলে ধরেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ডিসিপ্লিনের প্রভাষক মো. আসাদুজ্জামান। আমরাই বাংলাদেশ’কে দেয়া তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিচে তুলে ধরা হলো-

 

জীবনের শুরুর গল্পটা কেমন ছিল?
আসাদুজ্জামান: আমি বেড়ে উঠেছি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি থানার পান্টি ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ৭ বোনের একমাত্র ভাই আমি৷ বাবা- মা, বোনের বিশাল স্নেহের সাথে শাসন ছিলো। যদিও খুব ছোটবেলায় স্কুলের প্রতি অনীহা ছিলো, স্কুলে যেতে ভালো লাগতো না। তার চেয়ে ভালো লাগতো ধানের ক্ষেত ছুঁয়ে দৌড়াতে। বৃষ্টির দিনে উঠানে বৃষ্টিতে গড়াগড়ি দিতে৷ স্থানীয় কৃষ্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। আমার নাজমা আপা (৪র্থ) আমাকে লেখাপড়ার অক্ষরজ্ঞান দিতেন৷ তিনিই হাত ধরে স্কুলে পৌঁছে দিতেন। বিদ্যালয়ের গন্ডি পার হয়েই স্থানীয় এনায়েত পুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে থেকে এসএসসি পাশ করি৷ স্কুল জীবনে কখনো ২য় হইনি। আমি নিয়মিত স্কুলে যেতাম ও স্কুল কামাই দিতাম না। নতুন প্রতিষ্ঠিত স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাশ করে পার্শ্ববর্তী কাতলাগাড়ি কলেজে ভর্তি হই। কলেজ জীবনেও নিয়মিত ক্লাস করতাম। কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাশ করে ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হই। ২০১০-১১ সালে ইবিতে প্রথমে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা দিয়ে উৎফুল্ল ছিলাম। দেখি মেরিট লিস্টে নাম-রোল এসেছে। যেহেতু নিজ জেলা আর পছন্দের সাবজেক্ট- অতএব ব্যাটে-বলে মিলে গেলো। তাই সেবার আর বাইরে পরীক্ষা দিইনি। অভিভাবকদের পরামর্শে ইবিতে আইনে ভর্তি হয়ে যাই।

পড়াশোনার পাশাপাশি কী কী বিষয়ে আপনার আগ্রহ?
আসাদুজ্জামান: পড়াশোনায় প্রথম থেকেই মনোযোগী। ক্লাসের পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যান্য বইয়ের প্রতি আকর্ষণ বোধ করতাম। কুষ্টিয়ার বইমেলা লাইব্রেরিতে আইনের বই কিনতে গিয়ে যে কতবার উপন্যাস, দর্শন, ফ্রয়েডের বই কিনেছি ঠিক নেই। সেগুলো গোগ্রাসে গিলতাম। সারা বিকেল, কখনো মধ্যরাত পর্যন্ত। সুনীল, সমরেশ, হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ দাশ, শীর্ষেন্দু, সত্যজিৎ, শার্লক হোমস সহ কত বিচিত্র বই!! বইয়ের পরে বই পড়তাম। বই কেনার জন্য টিউশনিও করেছি। এছাড়া একাডেমিক বই তো অবশ্যপাঠ্য ছিলো। এসব বইয়ের বিচিত্রতা আমাকে মুগ্ধ করতো, ভাবাতো। পড়াশোনার পাশাপাশি বই পড়া আমার নেশা। এ ছাড়া প্রকৃতির মাঝে ডুবে থাকতে ভালো লাগে। এখনো সময় পেলেই মাঠে-ঘাটে বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াই।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আপনার ক্যারিয়ার ভাবনার শুরু গল্প কেমন?
আসাদুজ্জামান: বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ণকালে প্রথম বর্ষের ক্লাসেই সম্মানিত প্রফেসর ড.সেলিম তোহা স্যারের দিকনির্দেশনা, উৎসাহ, জীবনের লক্ষ্য, নৈতিকতা এবং যেকোন সমস্যায় শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। স্যারের দিকনির্দেশনাতেই আমার মত গ্রামের ছেলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ আরও সহজ হয়ে যায়। এরপর ড. জহুরুল ইসলাম স্যারের গুরুগম্ভীর জুরিস্প্রুডেন্স ক্লাস, ড. করিম খান স্যারের স্নেহময় আদরের ডাক, ড. শাহজাহান মন্ডল স্যারের ইংলিশ ক্লাস বুঝতে শুরু করলাম। শুরু হয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা চলাকালেই দেশ বিদেশের নামী-দামী শিক্ষকদের লেকচার শোনার জন্য ঢাকায় ছুটেছি অনেকবার। সেই সূত্রে, ঢাবির ছাত্রছাত্রীদের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে যায়৷ বড় ভাইয়েরা খুব সহযোগিতা করেছেন। ২০০৭-৮ সেশনের আয়াজ আজাদ ভাই (বাংলাদেশ ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা), মেফতাহুল হাসান সান ভাই (শিক্ষক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়), মিলন ভাই (সহকারী জজ, পাবনা) ভাইদের পরামর্শ আর দিক নির্দেশনায় এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিসে যোগ দিতাম। ভাইয়েরা বলে দিতেন কোথায় কোন প্রোগ্রাম আছে। নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য এর বিকল্প ছিলো না।

শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখার শুরু কখন?
আসাদুজ্জামান: স্বপ্ন সবাই দেখে। স্কুলের খাতায় "আমি ডাক্তার হতে চাই" লেখাটা যতটা সহজ বাস্তব জীবনে ততটা সহজ নয়। নিজেকে নিয়ে কখনো ভাবিনি৷ শুধু মা কে জিজ্ঞেস করেছিলাম "কি চাকুরী করলে খুশি হও? যদিও বহির্বিশ্বের আইনে পড়ে এত সুযোগ আছে তা আমার মা জানতেন না। শুধু বলেছিলেন, "যাই-ই করো, সৎ ভাবে আয় করো। সেটা যে চাকরিই হোক।" বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে ব্যারিস্টার বানাবেন আবার আমি তার একমাত্র ছেলে৷ কারন কোর্ট বিষয়ে বাবার সম্যক ধারণা ছিল। উনি প্রায়ই আক্ষেপ করতেন আজকাল ভাল উকিল নেই। সবাই টাকার পিছনে ছোটে৷ তাই ছেলে ব্যারিস্টার হয়ে চেম্বার দিয়ে বসবে। কিন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ড.শাহজাহান মন্ডল স্যার বলেছিলেন "আমি হইলাম উকিলদের স্যার, জাজদের স্যার।" এ কথাটা আমার মাথায় গেথে যায়৷ উকিল, ব্যারিস্টার, জাজ না হয়েও তো এদের তৈরি করার মতো স্যার হওয়া যেতে পারে। শিক্ষক হওয়ার বাসনা তখন থেকেই তৈরি হয়।
২০১৮ সালেই ইবিতে ল এন্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের জন্য এপ্লাই করেছিলাম। রিটেনে কোয়ালিফাই করি কিন্ত ভাইভাতে বাদ পড়ি। দূর্ভাগ্যবশত সেবার চাকরি হয়নি। আলহামদুলিল্লাহ। মানসিকভাবে কষ্ট পেয়েছিলাম। কারন স্বপ্ন তো এইটাই, শিক্ষক হবো আমি৷ স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়ে কুষ্টিয়া শহর ছেড়ে গ্রামে চলে আসি। তারপর ঢাকা চলে যাই। পরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করি। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভাতে বাদ পড়ি৷ পরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবার নিয়োগ বোর্ডের চিঠি আসে। আমার মা এবং শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের দোয়া নিয়ে রিটেন উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভা সমাপ্ত করি ও সেদিনই ঢাকা চলে আসি৷ পরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ডিন মহোদয় সিন্ডিকেট মিটিং শেষে আমাকে অভিনন্দন জানান। এরপর থেকে আমার স্বপ্ন এখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে।

অনুজদের জন্য পরামর্শ
আসাদুজ্জামান: যারা আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত হতে চাও - নিজেকে সমৃদ্ধ করার বিকল্প কিছুই নেই৷ আইনের যে ধারা গুলো তুমি পড়বে সেগুলো অন্যরাও পড়বে তবে সেগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে সবাই পারবে না৷ প্রচুর বই পড়তে হবে, বিশ্বের ভালো ভালো মুভি দেখতে হবে এবং সেগুলো নিয়ে প্রচুর ভাবতে হবে। প্রচুর চিন্তা করতে হবে। আগ্রহ জাগাতে হবে অজানার প্রতি।
স্বপ্ন স্থির করে ফেলো, সে তুমি যেটাই হতে চাওনা কেনো৷ তারপর স্বপ্নের পিছনে ছুটতে হবে। প্রথমবারেই সাফল্য আসবে এমন নয়। চেষ্টা, ধৈর্য তোমার সফলতা আনবে। জীবনে ভালো বিশ্বস্ত বন্ধু খুজে বের করো। তাদের কাছে শেয়ার করো। যে কাজগুলো ভাল লাগে করতে থাকো৷ নিজের পছন্দ কে গুরুত্ব দাও৷ শিক্ষকদের কথা মন দিয়ে শোনো। তাদের দর্শন, প্রজ্ঞা, চিন্তাভাবনা কে ধারণ করো। প্রয়োজনে যেকোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করো। অন্যের মতামত কে শ্রদ্ধা করো। যেহেতু আইন একটা বৈশ্বিক পাঠ অতএব শুধু কতিপয় ধারায় জীবনকে আবদ্ধ করে রেখো না। ছড়িয়ে দাও নিজেকে। পড়ার কোনো বিকল্প নেই তাই আইন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, ধর্ম, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্যসহ সব বিষয়ে পড়তে হবে৷

সর্বশেষ বলতে চাই, বাবা-মায়ের দোয়ার চেয়ে বড় কিছুই নেই৷ বাবা-মায়ের দোয়া ছাড়া শুধু শ্রম দিয়ে কিছুই হবে না৷ তাদের কাছে দোয়া চাইতে হবে। শিক্ষকদের কাছে দোয়া নিতে হবে৷ সিনিয়রদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হয়৷ তাঁদের পরামর্শ নিতে হবে৷

 

এবি/এসএন

২৯ ডিসেম্বর ২০২১, ০৫:৩৩পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।