জানা-অজানার আফ্রিকা মহাদেশ
আয়তন এবং জনসংখ্যার দিক থেকে আফ্রিকা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশ। মূলত পূর্ব এবং উত্তর গোলার্ধের প্রধান অংশে আফ্রিকা মহাদেশটি অবস্থিত।
আপনি কি জানেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ভারতের সম্মিলিত আয়তনের থেকেও আফ্রিকা আয়তনে বড়? আফ্রিকা মহাদেশটি ৩০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত!
আফ্রিকা মহাদেশে মোট ৫৪ টি দেশ এবং ৯টি নির্ভরশীল অঞ্চল রয়েছে। মহাদেশটিতে ১৩০ কোটিরও বেশি লোকের বসবাস। এর অর্থ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫% আফ্রিকায় বাস করে!
বৃহত্তম দেশ
আফিকা মহাদেশের বৃহত্তম দেশ আলজেরিয়া। এই দেশটি বিশ্বের দশটি বৃহৎ আয়তনের দেশের মধ্যে একটি।
আফ্রিকার সর্বাধিক জনবহুল দেশ নাইজেরিয়া, দেশটিতে প্রায় ২২ কোটি লোক রয়েছে, তবে দেশটি আকারে আলজেরিয়ার মাত্র এক তৃতীয়াংশ।
বৃহত্তম শহর
আফ্রিকার বৃহত্তম শহর নাইজেরিয়ার লেগোস। এর জনসংখ্যা ২.২ কোটিরও বেশি। লোগোস বিশ্বের বৃহত্তম মেট্রোপলিটন শহর সমূহের মধ্যে অন্যতম। ধারণা করা হয় ২১০০ সালে এর জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১০০ কোটিরও বেশি এবং এটি বিশ্বের বৃহত্তম শহর হয়ে উঠবে! মিশরের কায়রো আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর যেখানে প্রায় ২.১ কোটি লোকের বসবাস।
ক্ষুদ্রতম দেশ
আফ্রিকার ক্ষুদ্রতম দেশ সিশিলিশ, যা ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপপুঞ্জ । আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডে সবচেয়ে ছোট দেশটি গাম্বিয়া।
বৃহত্তম দ্বীপ
ভারত মহাসাগরে অবস্থিত মাদাগাস্কার মহাদেশটির বৃহত্তম দ্বীপ। গ্রীন্ডল্যান্ড, নিউ গিনি এবং বোর্নিওর পর মাদাগাস্কার বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম দ্বীপ।
দীর্ঘতম নদী
নীলনদ এই মহাদেশের দীর্ঘতম নদী যার দৈর্ঘ্য ৬,৮৫২ কি.মি.। শুধু আফ্রিকা নয় বরং নীলনদ পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী। এগারোটি দেশের মধ্য দিয়ে এটি প্রবাহিত হয়েছে।
সর্বোচ্চ পর্বত
তানজানিয়ায় মাউন্ট কিলিমঞ্জারো এই মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত। এর সর্বোচ্চ চূড়াটির নাম ‘উহুরু পীক’ যা প্রায় ১৯,৩৪০ ফুট উচু। পর্বতটি কেনিয়ার সীমান্তে তানজানিয়ান উচ্চভূমিতে অবস্থিত।
বৃহত্তম হ্রদ
উগান্ডা, তানজানিয়া এবং কেনিয়ার সীমানা জুড়ে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া হ্রদ আফ্রিকার বৃহত্তম হ্রদ। এছাড়াও এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির হ্রদ। এটি উত্তর আমেরিকার লেক সুপিরিয়র এর থেকে ছোট!
শুষ্কতম অঞ্চল
উত্তর আফ্রিকার সাহারা বিশ্বের বৃহত্তম উষ্ণ প্রান্তর। এই অঞ্চলে জলবায়ু অত্যন্ত শুষ্ক।
ভূমি বেষ্টিত দেশ
আফ্রিকাতে ষোলটি ল্যান্ডলকড বা ভূমি বেষ্টিত দেশ রয়েছে। এই দেশগুলি মহাদেশের অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে অবস্থিত এবং এদের সাথে আটলান্টিক মহাসাগর বা ভারত মহাসাগরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ নেই।
প্রাচীন ইতিহাস
ধারণা করা হয়ে থাকে আফ্রিকা থেকেই মানব জাতির সূচনা ঘটেছিল।
এখানেই প্রথম হোমিনিডস, মানুষ এবং তাদের নিকটাত্মীয় গরিলা এবং শিম্পাঞ্জি বিকশিত হয়েছিল। আফ্রিকাতে পাওয়া জীবাশ্মগুলি থেকে জানা যায় যে আধুনিক মানুষ সেখানে প্রায় ৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি বছর আগে বিকশিত হয়েছিল। তারপর তারা এই মহাদেশ থেকে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
মানব জীবনের অনত্যম প্রাথমিক নির্শন দক্ষিণ আফ্রিকাতে পাওয়া গেছে। ‘মিসেস প্লিজ এবং তাওং চাইল্ড সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন জীবাশ্মগুলির মধ্যে একটি।
প্রাথমিক ইতিহাস এবং মধ্যযুগের ইতিহাস থেকে জানা যায় আফ্রিকা মহাদেশে অনেকগুলি শক্তিশালী রাজ্য বিদ্যমান ছিল। তবে উনিশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপীয়ানরা আফ্রিকা দখল করতে শুরু করে এবং সেখানে তাদের উপনিবেশ গড়ে তোলে। ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে পর্তুগাল, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ডাচ, ইতালিয়ান, জার্মান এবং বেলজিয়ানরা সেখানে উপনিবেশ গড়ে তোলে শোষণ নিপীরন চালিয়ে যায়।
আফ্রিকার লোক সম্প্রদায়
আফ্রিকাতে প্রায় ৩০০০ এরও বেশি আদিবাসীদের সম্প্রদায় রয়েছে। তাদের সবার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। গত শতাব্দী অবধি আফ্রিকা উপনিবেশিক শোষণ ও শাসনের অধিন থাকার কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ আফ্রিকান জনগোষ্ঠী এখন প্রায় নিঃস্ব এবং দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। বেশিরভাগ আফ্রিকান দেশগুলি ১৯৫০ এবং ৬০ এর দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
দরিদ্র ও উন্নত দেশ
আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশ মালাউই, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র এবং বুরুন্ডি। সর্বাধিক উন্নত ও ধনী দেশগুলির মধ্যে রয়েছে সেশেলস, লিবিয়া, মরিশাস, আলজেরিয়া, মিশর, বতসোয়ানা, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নাইজেরিয়া।
আফ্রিকার ভাষা
অনুমান করা হয় যে আফ্রিকা মহাদেশে প্রায় ২ হাজার ভাষা লোক মুখে প্রচলিত আছে। অনেক আফ্রিকান ব্যক্তি বেশ কয়েকটি আফ্রিকান ভাষা এবং একটি ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলতে পারে। বিভিন্ন দেশে লোকেরা অতিরিক্ত ভাষা হিসাবে ইংরেজি, ফরাসী বা পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলে। এই বিদেশী ভাষাগুলি প্রায়শই অফিসিয়াল যোগাযোগ এবং ব্যবসার কাজে ব্যবহৃত হয়। আফ্রিকাতে ইংরেজী বহুলাংশে ব্যবহৃত হয়, কারণ এই মহাদেশের অনেক দেশ আগে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। উত্তর আফ্রিকাতে আরবি ভাষার প্রচলন রয়েছে। উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশে অফিসিয়াল ভাষা হিসাবে আরবিও ব্যবহৃত হয়। তবে পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলিতে সোয়াহিলি ভাষায় কথা বলা হয়।
ধর্ম
আফ্রিকার বেশিরভাগ মানুষ খ্রিস্টান বা ইসলাম ধর্মের অনুসারী। উত্তর আফ্রিকা এবং পশ্চিম আফ্রিকার অধিকাংশ দেশগুলিতে মানুষ মূলত ইসলাম ধর্মের অনুসারী, দক্ষিণ ও পূর্ব আফ্রিকাতে খ্রিস্টান ধর্মের প্রাধান্য রয়েছে। তবে আফ্রিকান প্রায় ১০% মানুষ ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করে।
পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান
- দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের টেবিল মাউন্টেন
- মিশরের পিরামিড
- কেনিয়ার মাসাই মারা জাতীয় উদ্যান
- দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রুগার জাতীয় উদ্যান
- ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত
- নামিব মরুভূমি এবং ইটোশা জাতীয় উদ্যান
- মরিশাস এবং ভারত মহাসাগর দ্বীপপুঞ্জ
- তাঞ্জানিয়ায় মাউন্ট কিলিমঞ্জারো
- মরক্কো - মার্কেটস, মরুভূমি এবং পর্বতমালা
প্রাণী
আফ্রিকাতে আপনি পৃথিবীর বৃহত্তম স্তন্যপায়ী বেশ কয়েকটি প্রাণীকে দেখতে পাবেন। এর মধ্যে রয়েছে স্থল ভাগের সব থেকে বৃহত্তম স্তন্যপায়ী আফ্রিকান হাতি, সবচেয়ে দীর্ঘতম স্তন্যপায়ী জিরাফ এবং দ্রুততম স্তন্যপায়ী চিতা।
আফ্রিকাতে হোয়াইট এবং ব্ল্যাক গন্ডারের মতো অনেক বিপন্ন প্রাণীও রয়েছে। ক্রুগার জাতীয় উদ্যানে এসব প্রাণীর দেখা পেয়ে যেতে পারেন, এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত জাতীয় উদ্যান এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অঞ্চল।
প্রাকৃতিক সম্পদ
আফ্রিকার প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ হলো খনিজ তেল, তামা, সোনা, হিরা ও প্ল্যাটিনাম। কৃষিজাত সম্পদের মধ্যে রয়েছে ভুট্টা, কফি, গম এবং ফল। সমস্ত আফ্রিকার জনসংখ্যার প্রায় ৬৫% কৃষিক্ষেত্রে কাজ করে।
ভূপ্রকৃতি
আফ্রিকা মহাদেশের অর্ধেকেরও বেশি অংশ তৃণভূমি বা সাবান্নাহ দ্বারা আচ্ছাদিত। উত্তর আফ্রিকায় বিস্তীর্ণ সাহারা মরুভূমি এবং আধা-শুকনো সাহেল অঞ্চলের আধিপত্য রয়েছে, তবে এ অঞ্চলেও নীল নদ-বদ্বীপের উর্বর জমিও রয়েছে। মধ্য আফ্রিকায় রেইন ফরেস্ট, উপকূলীয় সমভূমি এবং মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতমালা এবং হ্রদ রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা মূলত একটি উঁচু মালভূমি এবং সেখানে একটি ছোট উপকূলীয় অঞ্চল আছে।
অন্যান্য
- সাহারা মরুভূমি পৃথিবীর সবচেয়ে শুকনো এবং উষ্ণ মরুভূমি
- নীল নদ পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী
- দক্ষিণ আফ্রিকার তুগেলা জলপ্রপাত আফ্রিকার সর্বোচ্চ জলপ্রপাত
- দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লাইড রিভার ক্যানিয়ন হলো বিশ্বের বৃহত্তম সবুজ উপত্যকা
তথ্যসূত্র: কিডস ওয়ার্লড ট্রাভেল গাইড।
এনজে