• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকাই সিনেমার ‘মিস ডায়না’ : মৌসুমীর কেয়ামত থেকে কেয়ামত

ঢাকাই সিনেমার ‘মিস ডায়না’ :  মৌসুমীর কেয়ামত থেকে কেয়ামত

ফাইল ছবি

বিনোদন ডেস্ক

আরিফা পারভিন জামান। ছোটবেলা থেকেই অভিনেত্রী এবং গায়িকা হওয়ার স্বপ্ন ছিল মেয়েটির। ১৯৯০ সালে স্বপ্ন পূরণে “আনন্দ বিচিত্রা ফটো বিউটি কনটেস্ট” প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন খুলনার মেয়ে আরিফা। এরপরই তিনি টেলিভিশনের বাণিজ্যিকধারার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সুযোগ পেতে থাকেন তিনি। প্রিয় দর্শক, বলছি চিত্রনায়িকা মৌসুমীর গল্প।

চলচ্চিত্রে মৌসুমীর পথচলা শুরু ১৯৯৩ সালে। বাংলা চলচ্চিত্রের তখন ভরা মৌসুম বলা চলে। বরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান বড় পর্দায় নিয়ে আসেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমা। বাংলা চলচ্চিত্রের বরপূত্র কিংবদন্তী নায়ক সালমান শাহের বিপরীতে ওই সিনেমায় অভিষেক হয় মৌসুমির। প্রথম সিনেমাতেই বাজিমাত করেন এই নায়িকা।

বাংলা সিনেমার অন্যতম সফল ও সেরা এই অভিনেত্রী ১৯৭৩ সালের ৩ নভেম্বর খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন। গুণী এই অভিনেত্রীর বাবার নাম নাজমুজ্জামান মনি, মায়ের নাম শামীমা আক্তার জামান। বাংলা চলচ্চিত্রে অভিষেকের পর আরিফা পারভিন জামান মৌসুমী নামেই পরিচিত হয়ে উঠেন।

মৌসুমী অভিনীত প্রথম সিনেমা

মৌসুমী অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। সালমান শাহের সঙ্গে জুটি বেঁধে এই সিনেমায় দর্শকদের মন জয় করেন মৌসুমী। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এখনো দর্শক নন্দিত সেরা সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’।

দাপুটে অভিনয়ের মাধ্যমে তৎকালীন সব নায়িকাদের পেছনে ফেলে দেন মৌসুমী। সেই হিসেবে নব্বই দশকের সেরা নায়িকা হিসেবে মৌসুমীর নাম সবার ওপরে।

মৌসুমীর বর্নাঢ্য কর্মজীবন

১৯৯৩ সালে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছায়াছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রাঙ্গনে পদার্পণ করেন মৌসুমী। প্রথম চলচ্চিত্রে তার বিপরীতে ছিলেন অকাল প্রয়াত অভিনেতা সালমান শাহ। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমা ছিল দুজনেরই প্রথম চলচ্চিত্র। সিনেমাটি তখনকার সময়ে ১৩ কোটি টাকা আয় করে। যা ইতিহাসে রেকর্ড ব্যবসা করার নজির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এক সিনেমা দিয়েই মৌসুমী দেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এরপর ১৯৯৩ সালে ওমর সানির সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেন ‘দোলা’ সিনেমায়। দোলা সিনেমাতেও তিনি জনপ্রিয়তা পান। পরের বছর সালমান শাহের বিপরীতে গীতিকার ও পরিচালক গাজী মাজহারুল আনোয়ার পরিচালিত ‘স্নেহ’, শিবলি সাদিক পরিচালিত ‘অন্তরে অন্তরে’ ও শফি বিক্রমপুরির ‘দেনমোহর’ ছায়াছবিতে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

এছাড়া ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘গরীবের রানী’, ‘সুখের ঘরে দুখের আগুন’, ‘লুটতরাজ’, ‘আম্মাজান’, ‘মগের মুল্লুক’ সিনেমায় অভিনয় করেও ব্যাপক সাড়া ফেলেন। এ ছাড়া ‘পরাধীন’, ‘রক্তের অধিকার’, ‘বউয়ের সম্মান’, ‘সুখের আশায়’, চলচ্চিত্রে নিজেকে ভিন্ন ভাবে তুলে ধরেন এই গুণী অভিনেত্রী। পাশাপাশি বেশ কিছু সিনেমায় নিজেকে আবেদনময়ী হিসাবেও তুলে ধরেন মৌসুমী।

নায়িকা মৌসুমী অভিনীত অন্যান্য ব্যবসা সফল সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘মেঘলা আকাশ’। এই সিনেমার জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার অর্জন করেন। এ ছাড়া ‘লাল দরিয়া’ সিনেমাতেও বাজিমাত করেন তিনি।

২০০৩ সালে প্রথম সিনেমার পরিচালক হিসেবে আবির্ভূত হন চিত্রনায়িকা মৌসুমী। পরিচালনা করেন ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ সিনেমা। লাস্যময়ী মৌসুমী পরিচালনার পাশাপাশি অন্যান্য সিনেমায় অভিনয় চালিয়ে নিয়েছেন একতালে। তিনি অভিনয় করেছেন ‘বীর সৈনিক’, ‘খায়রুন সুন্দরী’, ‘মাতৃত্ব’, ‘মোল্লা বাড়ীর বউ’, ‘মেহের নিগার’ ছায়াছবিতে অভিনয় করেন। মেহের নিগার সিনেমাটি তিনি নিজেই পরিচালনা করেন।

পরে ‘একজন সঙ্গে ছিল’, ‘বাবা আমার বাবা’, ‘গোলাপী এখন বিলাতে’, ‘কুসুম কুসুম প্রেম’, ‘প্রজাপতি’, ‘দুই পুরুষ’, ‘দেবদাস’, ‘কিছু আশা কিছু ভালোবাসা’, ‘তারকাঁটা’, ‘এক কাপ চা’ সিনেমায় অভিনয় করেন এই নায়িকা।

তারকাঁটা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মৌসুমী লাভ করেন তৃতীয় বারের মত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এছাড়াও এক কাপ চা চলচ্চিত্রের জন্য সমালোচকদের বিচারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পী (নারী) হিসেবে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার লাভ করেন তিনি।

২০১৫ সালে ঈদে মুক্তি পায় ইন্দো-বাংলা প্রযোজনায় আশোক পাতি ও আব্দুল আজিজ পরিচালিত মৌসুমী অভিনীতি প্রথম সিনেমা ‘আশিকী’। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি নায়িকা মৌসুমী টেলিভিশন নাটক ও টেলিফিল্মেও ছিলেন দুর্দান্ত দাপুটে।

২০১৬ সালে চিত্রগ্রাহক জেড এইচ মিন্টুর নির্দেশনায় ‘মেঘের আড়ালে’ টেলিফিল্মে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান এই গুণী অভিনেত্রী। একই বছর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আফতাব বিন তমিজের নির্দেশনায় ‘অতীত হারায়ে খুঁজি’ টেলিফিল্মেও কাজ করেন মৌসুমী।

প্রযোজনা

১৯৯৬ সালে ‘গরীবের রানী’ ছায়াছবিতে বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে প্রযোজকের খাতায় নাম লেখান মৌসুমী। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘কপোতাক্ষ চলচ্চিত্র’ নামের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। একই বছর নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে ‘সুখের ঘরে দুখের আগুন’ ও ‘বউয়ের সম্মান’ ছায়াছবির প্রযোজনা করেন মৌসুমী।

এ ছাড়া ২০০৩ সালে ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ সিনেমা পরিচালনাও করেন ড্যাসিং এই চিত্রনায়িকা। বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের ‘ড্রিমগার্ল’ খ্যাত মৌসুমীর রূপালি পর্দার জীবন যেন সফলতায় মোড়ানো। তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন তাতেই যেন সোনা ঝরেছে। চলচ্চিত্রে অভিনয়, প্রযোজনা ও পরিচালনার পাশাপাশি সিনেমার গানে কণ্ঠও দিয়েছেন এই গুণী অভিনেত্রী।

২০০৪ সালে জাহিদ হোসেন পরিচালিত ‘মাতৃত্ব’ ছায়াছবির একটি গানে কণ্ঠ দেন মৌসুমী। এছাড়া ২০০৭ সালে ইথুন বাবুর সুরে এবং ২০১৪ সালে মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত তারকাঁটা ছায়াছবিতে ‘কি যে শূন্য লাগে তুমিহীনা’ গানে কণ্ঠ দেন এই সব্যসাচী অভিনেত্রী।

রূপালি ক্যারিয়ারে চিত্রনায়িকা মৌসুমী তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। ছয়বার জিতেছেন ‘বাচসাস’ পুরস্কার। সেই সঙ্গে তিনবার মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার অর্জন করেছেন মৌসুমী।

আলোচিত স্ক্যান্ডাল ও মৌসুমি

চলচ্চিত্র কিংবা টিভি তারকা, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে সমালোচনার যেন শেষ নেই। তবে ক্লিন ইমেজের মৌসুমী বরাবর ছিলেন সমালোচনার ঊর্ধ্বে। বেশ কয়েকবার মৌসুমীকে নিয়ে স্ক্যান্ডালের খবর চাউর হলেও সেসব খবর দিন শেষে ধোপে টেকেনি। ২০১৪ সালে প্রায় দেড় মিনিটের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেই ভিডিওতে নায়িকা মৌসুমীর দিকে নগ্নতার অভিযোগে আঙুল তোলে ভক্তরা। তবে দিন শেষে জানা যায়, ভিডিওটি ছিল ‘মাস্টার কপি কাটপিস’।

আবার কয়েকটি সিনেমায় ছোট পোশাক পরে দর্শক-ভক্তদের সমালোচনার মুখেও পড়েন এই ড্যাসিং নায়িকা। ‘মিস ডায়না’ ও ‘লাভ ইন থাইল্যান্ড’ সিনেমায় অভিনয় করে দর্শকদের তুমুল সমালোচনা ও নিন্দার মুখে পড়েন মৌসুমী।

এ ছাড়া বেশ কয়েকবার ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে মৌসুমীর নামে স্ক্যান্ডাল ভাইরাল হলেও সেসব স্ক্যান্ডালের সত্য-মিথ্যা নিয়ে রহস্য থেকেই গেছে। তবে সম্প্রতি নায়ক জায়েদ খান ও মৌসুমী ইস্যু যেন অতিতের সব সমালোচনাকে ছাঁড়িয়ে গেছে। স্বামী চিত্রনায়ক ওমর সানীর চাঞ্চল্যকর বক্তব্যের পর মৌসুমী ও জায়েদকে নিয়ে নানা রকম গল্প নেট দুনিয়ায় ভাসতে থাকে। যদিও জায়েদ খান ও মৌসুমী সেসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন।

প্রিয় দর্শক, ভাইরাল কোনো স্ক্যান্ডালের জালে নিজেকে না জড়ালেও নায়িকা মৌসুমীর ‘স্ক্যান্ডাল’ আছে। প্রতিষ্ঠিত সেই ‘স্ক্যান্ডাল’ এখনো আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে। যে ‘স্ক্যান্ডাল’ এর পর নায়িকা মৌসুমীকে নিয়ে সমালোচনার পরিবর্তে প্রশংসা ছড়িয়েছিল। আর সেই ‘স্ক্যান্ডাল’ হলো নায়িকা মৌসুমী পরিচালিত সিনেমা। যেই সিনেমার নামই ‘স্ক্যান্ডাল’।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৯৬ সালের ২ আগস্ট জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ওমর সানীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবন্ধ হন মৌসুমী। বাংলাদেশের সবচেয়ে সুখী ও স্টাইলিশ তারকা দম্পতি হিসেবে খ্যাত মৌসুমী-ওমর সানীর রয়েছে এক ছেলে এক মেয়ে। মৌসুমী-সানী দম্পতির ছেলের নাম ফারদিন এহসান স্বাধীন ও মেয়ের নাম ফাইজা।

চলচ্চিত্র নিয়ে জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করলেও বর্তমানে সেবামূলক ‘মৌসুমী ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এই গুণী অভিনেত্রী। নিজেই প্রতিষ্ঠানটির দেখাশুনা করেন। এছাড়া ফ্যাশন ডিজাইনার হিসাবেও কাজ করতে পছন্দ করেন মৌসুমী।

বর্নাঢ্য কর্মজীবনে কৃতিত্বপূর্ণ কাজ ও অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ চিত্রনায়িকা মৌসুমী বেশ কিছু সম্মাননাও পেয়েছেন। বাংলাদেশের শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জনমত ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নায়িকা মৌসুমী ইউনিসেফ অ্যাডভোকেটের দায়িত্ব পান। এছাড়া ২০১৯ সালের ১৬ জুন মৌসুমীকে আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাব আজীবন সম্মাননা প্রদান করে।

১০ আগস্ট ২০২২, ০৭:১৬পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।