• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলার বাঘ: কিংবদন্তী রাজনীতিক একে ফজলুল হক

বাংলার বাঘ: কিংবদন্তী রাজনীতিক একে ফজলুল হক

ফাইল ছবি

ফিচার ডেস্ক

শের-এ-বাংলা একে ফজলুল হক। এটি শুধু নামই নয়, বরং বাংলার পরিচয়। আবুল কাশেম ফজলুল হক তাঁর প্রকৃত নাম। ডাকনাম শের-এ-বাংলা, যার অর্থ ‘বাংলার বাঘ’। রাজনৈতিক জীবনে অত্যন্ত সফল ব্যক্তিত্বের নাম ‘শেরে বাংলা’। কলকাতার মেয়র, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী থেকে শেষ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনরের দায়িত্ব কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করেন তিনি। বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সম্পর্কে আজ আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। দেখে নেয়া যাক বিস্তারিত-

পরিচয়

১৯৭২ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সাতুরিয়া তাঁর মামার বাড়ি। বিখ্যাত বাঙালি রাজনীতিক, লেখক ও আইনজীবী এই শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের আদি পৈতৃক নিবাস পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলায়। তাঁর বাবার নাম কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ এবং মাতার নাম সাইদুন্নেসা খাতুন। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি কূটনীতিক হিসেবে পরিচিত লাভ করেন শেরে বাংলা। তবে রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের নিকট তিনি ‘হক সাহেব’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।

এ. কে. ফজলুল হক এম.এ. পাশ করার পর দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করেন। এ সময় নবাব আবদুল লতিফ সি. আই. ই. এর পৌত্রী খুরশিদ তালাত বেগমের সাথে তার বিয়ে হয় একে ফজলুল হকের। খুরশিদ তালাত বেগম দুটি কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার পর মারা যান। পরে শেরে বাংলা হুগলী জেলার জিনাতুন্নেসা বেগম নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। জিনাতুন্নেসাও অল্প কিছুদিন পর মারা গেলে ১৯৪৩ সালে এ. কে. ফজলুল হক মীরাটের এক ভদ্র মহিলাকে বিয়ে করেন। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শুক্রবার সকালে ৮৮ বছর বয়সে একে ফজলুল হক মৃত্যু বরণ করেন।

শিক্ষাজীবন

এ. কে. ফজলুল হকের প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই শুরু হয়। পরে তিনি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হন। গৃহ শিক্ষকদের কাছে তিনি আরবি, ফার্সি এবং বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৮১ সালে তিনি বরিশাল জিলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৮৮৬ সালে অষ্টম শ্রেণিতে তিনি বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৮৯ সালে ফজলুল হক প্রবেশিকা পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেন। ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন শেরে বাংলা। এফ.এ. পাশ করার পর তিনি গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় অনার্সসহ একই কলেজে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। ১৮৯৩ সালে তিনি তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণিতে বি.এ. পাশ করেন।

পরিবার-পরিজন

এ. কে. ফজলুল হকের পূর্বপুরুষ আঠারো শতকে ভারতের ভাগলপুর হতে পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার বিলবিলাস গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এ বংশের কাজী মুর্তজা একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। তার ছেলে কাজী মুহম্মদ আমিন। কাজী মুহম্মদ আমিনের ছেলে মুহম্মদ আকরাম আলী বরিশাল কোর্টে আইন ব্যবসা করতেন। তার দুই ছেলে কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ ও কাজী আবদুল কাদের। কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদের একমাত্র পুত্র ছিলেন এ. কে. ফজলুল হক।

রাজনৈতিক অর্জন

শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ১৯৩৫ সালে প্রথম কলকাতার মেয়র নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। দেশ বিভাগের পরে ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন একে ফজলুল হক। এ ছাড়া ১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ১৯৫৬-১৯৫৮ মেয়াদে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন। যুক্তফ্রন্ট গঠনের অন্যতম কারিগর শেরে বাংলা একে ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টির পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন।

বিশেষ ভূমিকা ও অর্জন

বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে জামালপুরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেই দাঙ্গা বন্ধ হয়। জামালপুর মহকুমাতে চাকরি করার সময় তিনি জমিদার ও মহাজনের যে নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভূমিকা নেন। এসময় তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক শ্রমিকদের বাস্তব অবস্থা নিজের চোখে পর্যবেক্ষণ করেন। সরকারের সাথে বনিবনা না হওয়ায় অল্পদিনের মধ্যেই তিনি চাকুরি ছেড়ে দেন।

♦ ১৯১৩ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে একে ফজলুল হক বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৫ সালে পুনরায় ঢাকা বিভাগ থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
♦ ১৯১৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ পরিষদের সভায় মোট ১৪৮ বার বক্তৃতা করেন।
♦১৪৮ বার বক্তৃতার ভেতর ১২৮ বার তিনি দাঁড়িয়েছিলেন মুসলমানদের শিক্ষা সম্পর্কে বক্তৃতা দেয়ার জন্য।
♦শেরে বাংলার অদম্য চেষ্টার ফলে ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কারমাইকেল ও টেইলার হোস্টেল স্থাপন করা হয়েছিল।
♦১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স আহবান করেন। এই সম্মেলনে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ নিজে এবং যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন নবাব ভিকারুল মুলক এবং আবুল কাশেম ফজলুল হক। সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার আহসান মঞ্জিল-এ।
♦এই কনফারেন্সের জেরেই ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের সূত্রপাত ঘটে। ১৯১২ সালে একে ফজলুল হক মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯১৯ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট পদ লাভ করেন।
♦১৯১৪ সালে ফজলুল হক নিখিল ভারত কংগ্রেস দলে যোগ দেন। একই সঙ্গে তিনি মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস দলের নেতা হয়ে উঠেন। ১৯১৮ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন।
♦একে ফজলুল হক খেলাফত আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর খেলাফত আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এ. কে. ফজলুল হক নিখিল ভারত খেলাফত কমিটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
♦১৯২২ সালে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে একে ফজলুল হক খুলনা উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং নির্বাচিত হন।
♦১৯৩৫ সালে এ. কে. ফজলুল হক কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। তিনিই কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের প্রথম মুসলিম মেয়র।
♦তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ. কে. ফজলুল হক বহু কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। শিক্ষা ক্ষেত্রেই জোর দিয়েছিলেন বেশি। তার আমলে দরিদ্র কৃষকের উপরে কর ধার্য না করে সারা বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়। 'বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ'-এর পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেন। এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে 'ফ্লাউড কমিশন' গঠন করে।
♦১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের পক্ষ হতে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপন করেন এ. কে. ফজলুল হক। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসকারী মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি জানিয়ে উত্থাপিত প্রস্তাবনা।

 

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়া।

০৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০৪:৪১পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।