• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালির চিরায়ত লোকজ গণমাধ্যম ও যাত্রাপালা

বাঙালির চিরায়ত লোকজ গণমাধ্যম ও যাত্রাপালা

প্রতিকী ছবি

মাহবুব আলম

যাত্রার নাম শুনলেই আজকাল শহরে থিতু হওয়া মানুষদের হয়তো কৈশোর উঁকি দেবে! রাত জেগে খড় কিংবা ন্যাড়া বিছিয়ে বসে যাত্রাপালার সংলাপ শোনা ‘বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা...’। বাবা-চাচারা হয়তো স্মৃতিকাতর হয়ে যাবেন যাত্রাপালায় অভিনয়ের সময়ের কথা ভেবে। সর্বশেষ নব্বইয়ের দশকে বাঙালির প্রাচীন বিনোদন তথা লোকজমাধ্যম যাত্রাপালা আয়োজন হত প্রায়ই। গণমাধ্যমের সবচেয়ে প্রাচীনতম ধাপ হচ্ছে লোকজ মাধ্যম। এরপর সংবাদপত্র। এর বেশ অনেক পরে এসেছে টেলিভিশন। হাল আমলে অনলাইন পোর্টালসহ আরও কত কী?

আমাদের বিশাল বাংলাজুড়ে রয়েছে লোকমাধ্যমের সজীব উপস্থিতি। লোকমাধ্যমের নানান আঙ্গিক রয়েছে, যা থেকে যথার্থ আঙ্গিকটি খুঁজে নিয়ে আধুনিক গণমাধ্যমের সঙ্গে সমন্বয় করা যায়। উন্নয়ন-যোগাযোগে ব্যবহারের উপযোগিতাও নিরূপণ করা যায়। লোকমাধ্যম গণমানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য বলে নিরপেক্ষভাবে বার্তা প্রেরণ করা যায়। আমাদের অভ্যাস কিংবা জীবনাচরণে যে পরিবর্তন এসেছে তা-ও এই লোকজ গণমাধ্যমেরই ফল। এক্ষেত্রে কুদ্দুস বয়াতীর কথা বলা যেতেই পারে। তাই বিলুপ্তপ্রায় লোকমাধ্যমগুলোকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

স্বদেশী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, সর্বক্ষেত্রে লোকজ গণমাধ্যমের ভূমিকা অসামান্য। পেছনে ফিরলে দেখতে পাবো, মুকুন্দ দাসের যাত্রা মানুষকে কীভাবে স্বদেশি আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এটি আজ ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্য। ব্রিটিশ সরকার তা বুঝতে পেরেই তাঁর স্বদেশী যাত্রা একের পর এক নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। শুধু তা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, মুকুন্দ দাসকেও জেলে যেতে হয়। এতে যাত্রার প্রভাবকেই যেন স্বীকার করে নিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী। আরেকটু খোলাসা করে বললে বলা যায়, রাতের আঁদারে গ্রামীণ পরিবেশে কুপি কিংবা হ্যাজাকের আলোর রঙ্গমঞ্চ অর্থাৎ যাত্রাপালাকে ব্রিটিশ সরকার ভয় পেয়েছিল। কিন্তু যাত্রামঞ্চ বাঙালির বড় প্রিয় মাধ্যম। বাঙালি কখনও ভুলেনি। সুযোগ পেলেই আয়োজন করে বসতো 'দেবী সুলতানা', কিংবা 'রহিম রূপবানে'র মতো সামাজিক যাত্রাপালা। ভুলবেই বা কী করে? এই যাত্রাপালায় যে তাদেরই না বলা অনেক কথা প্রকাশিত হয়। যেখানে থাকে আবেগ, পাওয়া, না পাওয়া নানা কথাচিত্র।

'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'র নিবন্ধ থেকে জানা যায়, প্রাচীণ লোকজ গণমাধ্যম যাত্রা টিকে আছে সুদীর্ঘ কাল ধরে। গ্রামীণ মানুষের না বলা কথা, হাহাকার যাত্রাপালায় মঞ্চায়ন করে তাদের মাঝে প্রাণসঞ্চার করা হয়। এর সামজিক প্রভাবও ব্যাপক। তাই তো দীর্ঘকালেও এর বিলুপ্ত বা বর্জিত হয়নি। স্থায়িত্ব ও গ্রহণযোগ্যতাও এর সামাজিক প্রভাবের লক্ষণ।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও যাত্রাপালা জনসংযোগের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছে। গ্রামাঞ্চলে মঞ্চস্থ হয়েছে যাত্রাপালা। বাঙালির নিষ্পেষিত হওয়ার কাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছে যাত্রা। আলোড়িত হয়েছেন আপামর বাঙলার মানুষ। তপন বাগচী তার ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১৯টি যাত্রাপালা: একটি মূল্যায়ন’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ১৯টি পালা রচিত ও অভিনীত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যাত্রা লেখা হয়েছে, পেশাদার মঞ্চে অভিনীত হয়েছে। একাত্তর সালের পরেও এসব পালা বিভিন্ন যাত্রাদল আসরস্থ করে। পালাকার সত্যপ্রকাশ দত্তের পালা বাদে বাংলাদেশে যে আরও নয়টি পালার পরিচয় পাওয়া যায় তার মধ্যে পালাকার পরিতোষ ব্রহ্মচারী, কবিয়াল বিপিন সরকার এবং অভিনেত্রী জ্যোৎস্না বিশ্বাস রচিত পালা তিনটি বেশ মানসম্পন্ন।

জানা যায়, ইতিহাসের এই গৌরবের অধ্যায় নিয়ে ১৯টির মধ্যে অনেকগুলো গ্রন্থাকারে এখনও প্রকাশ হয়নি। এর মধ্যে ৮টি পালা রচিত ও মঞ্চস্থ হয়েছে ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘‘দুরন্ত পদ্মা’’ পালাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। যুদ্ধের ডামাডোলেই এটি রচিত। এই পালার বিভিন্ন চরিত্রে আর্মি মুক্তিযোদ্ধা, যুবলীগ নেতা, ছাত্রলীগ নেতা, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা, বামপন্থী শ্রমিক নেতা, গায়ক যোদ্ধা, চিকিৎসক যোদ্ধা, ছাত্রী যোদ্ধা, নার্স যোদ্ধা অভিনয় করেন। এছাড়া নিরাপদ মন্ডল রচিত ‘‘মুক্তিফৌজ’ পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরের টাউনশিপ গ্যারেজ ময়দানে ১৯৭১ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে (২ আশ্বিন ১৩৭৮) খেয়ালী নাট্যসমাজ মঞ্চায়ন করে। পালাটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় পালাকার নিরাপদ মণ্ডল লিখেছেন, পাকিস্তান সরকারের সৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে এগিয়ে এলো বাংলাদেশের তরুণ সমাজ। ‘জয়বাংলা’ ধ্বনিতে বাংলার আকাশ-বাতাস-মাটি মুখর হয়ে উঠলো। ইয়াহিয়া খান লেলিয়ে দিল তার সেনাবাহিনী। শুরু হলো বাঙালির ওপর অমানুষিক অত্যাচার; নেমে এলো দেশের বুকে রক্তের বন্যা। তারপর সব ইতিহাস। সে ইতিহাস রচনা হলো বাংলাদেশের তাজা তরুণ রক্তে। সেই রক্তের আখরে লেখা মুক্তিফৌজের অমর কাহিনী আমার অক্ষম লেখনীতে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।’ এই পালায় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে। যা জাতীয়তা বোধ জাগ্রত করতেও ভূমিকা রাখে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে, তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধ চলছে। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করছেন আওয়ামী লীগ নেতা তাহেরউদ্দীন। যাত্রার তাহেরউদ্দীন চরিত্র যেন তাজউদ্দীন আহমদের চরিত্র। তাহেরউদ্দীনের (তাজউদ্দীনের) কন্যা সাকিনা এ পালার অন্যতম নারীচরিত্র।

যাত্রা আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকেই ছিলো। যদিও এখন আকাশ সংস্কৃতির কারণে ভাটা পড়েছে। অথচ একটা সময় এই শিল্পটিকে কেন্দ্র করে একটি শ্রেণীর তৈরি হয়। বিশেষ করে বাদ্যযন্ত্র, সাজ-পোশাক এবং নারী শিল্পীদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপেরা হাউজ কিংবা সাজঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে হাল আমলে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন এগুলো বিলুপ্ত প্রায়।

সম্প্রতি নেত্রকোনার সাতপাই (কেডিসি) এলাকায় কথা হচ্ছিলো একটি অপেরা হাউজের শিল্পী সাগর সেনের সঙ্গে। তিনি যাত্রাপালায় বিবেক-এর চরিত্রে অভিনয় করতেন। তিনি জানালেন, এখন যাত্রাপালা খুব একটা হয় না। তাই জীবিকার তাগিদে পেশা বদল করে ভাতের হোটেল দিয়েছি। এমন অবস্থা শুধু সাগর সেনের নয়, আরও অনেকেরই। শূন্য দশকের শুরুর দিকেও দূর্গাপূজা কিংবা অন্যান্য উৎসবে সপ্তাহ বা পক্ষকালব্যপী যাত্রাগানের আয়োজন হতো। কিন্তু পরবর্তীতে বাংলা চলচ্চিত্রের মতো যাত্রাপালাতেও অশ্লীলতা ভর করে। অন্যদিকে এ ধরনের আয়োজনে জুয়াখেলার আধিক্যের কারণে স্থানীয় প্রশাসন তা বন্ধ করে দিয়েছে। যেহেতু যাত্রাপালা আবহমান গ্রাম বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ, তাই হাল আমলে সম্ভ্রান্ত থিয়েটার-নাটক বা সিনেমা-নাটকের কাছে যাত্রা-নাটক অপাঙক্তেয় শূদ্র শ্রেণির! লোককাহিনী, কিংবদন্তি এবং লেখকদের কল্পকাহিনী নিয়ে আজো অনেক নাটক-জাতীয় রচনা লেখা হচ্ছে- সাহিত্যের অঙ্গনে কদর নেই, তবু বাংলার স্নিগ্ধতা, মাটির রসতায় এর প্রাণ তাজা।

যাত্রাপালার মতো মতো সনাতন লোকজ মাধ্যমের সামাজিক প্রভাব ব্যাপক। আর প্রভাব আছে বলেই সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের মতো গণমাধ্যমের গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও কোনো কোনো দেশ এ মাধ্যমটির দিকে নজর দিয়েছে। আমাদেরও এ বিষয়ে নজর দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে লোকজ গণমাধ্যম নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশে লোকজ গণমাধ্যমের প্রভাব বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে আমরা আশির দশক থেকে নব্বইয়ের দশকে চোখ রাখতে পারি। ওই সময় সরকার গ্রামীণ মানুষের কাছে কোনো বার্তা পৌঁছাতে লোকজ মাধ্যমকে ব্যবহার করেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে আমরা এমন উদাহরণ দেখতে পাবো।

গণমাধ্যমের প্রধানত চারটি উদ্দেশ্যের কথা বলা হয় লোকসংস্কৃতি বা লোকমাধ্যম, বিশেষত যাত্রার উদ্দেশ্যও তার থেকে দূরে নয়। আধুনিক গণমাধ্যমের গতির কাছে, যাত্রাপালা কিংবা প্রচলিত মাধ্যমগুলো হার মানতে বাধ্য। কাজের ক্ষেত্রে ধীরগতি হলেও লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষমতা এর আছে।

তাই পশ্চিমা সংজ্ঞার্থের কাছে আটকা না পড়ে আমরা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারি। আমাদের দেশে এখনো সর্বাধিক মানুষ গ্রামে বাস করেন, স্বাক্ষরতার হারও সে অর্থে শতভাগ নয়। তাই মুদ্রণ মাধ্যম সর্বস্তরে পৌঁছাতে পারবে না। বেতার ও টেলিভিশনের গ্রহণযোগ্যতা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। যাত্রাসহ আরও যেসব লোকজ গণমাধ্যম রয়েছে সেগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে লোকজমাধ্যম হিসেবেই গণ্য করা হয়। যুগ-যুগ ধরে এই মাধ্যমটি টিকে আছে মানুষের জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতিকে ধারণ করে। সাধারণের সঙ্গে জনসংযোগ স্থাপন করতে পারে। তাই এটি শুধু যোগাযোগের একটি মাধ্যম মাত্র নয়, এটি মানুষের সমন্বিত আবেগ, মূল্যবোধ, আদর্শ এবং স্বপ্ন বিনিময়ের শিল্প হিসেবেও গণ্য। এ ধরনের শিল্প দেশ ও জাতির সংস্কৃতির শেকড় পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। যা উন্নয়ন যোগাযোগের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ।

লেখক: জনসংযোগ ও গণমাধ্যমকর্মী।

১৯ মার্চ ২০২৪, ১২:৩৫পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।