• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জীবন সংগ্রামে জয়ী অদম্য ইমদাদ এখন এএসপি

জীবন সংগ্রামে জয়ী অদম্য ইমদাদ এখন এএসপি

ছবি- ইমদাদ হোসেন বিপুল

শাহজাহান নবীন

ছোটবেলা থেকে কারো গাইড লাইন তিনি পাননি। কেউ কখনো তাকে বলেনি, তোমাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে। গ্রামের আর পাঁচজন সাধারণ কিশোরের মতোই তিনি বেড়ে উঠেছেন সাদাসিধে জীবনের গতিধারায়। গড়াই নদীর কলকল স্রোতের সুরে ঘুম ভাঙা শান্ত ছেলেটি পাড়ি দিয়েছেন জীবনের এক সংগ্রামী সময়। বাবার চাকরি হারানো, সংসারে অর্থের টানাটানি মাথায় নিয়েও তিনি এগিয়ে গেছেন নিজের কাঙ্খিত লক্ষপাণে। আর্থিক অস্বচ্ছলতার চোখ রাঙানি পেছনে ফেলে অদম্য মেধাবী ইমদাদ হোসেন বিপুল এখন সহকারি পুলিশ সুপার (এএসপি)। তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত রয়েছেন।

তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালী পৌরসভার তেবারিয়া গ্রামের আকবার হোসেন-মনোয়ারা খাতুন দম্পতির সন্তান। কুষ্টিয়ার এই কৃতি সন্তান কথা বলে বলেছেন ‘আমরাই বাংলাদেশ’র সঙ্গে। তিনি নিজের জীবনের নানা দিক, সফলতার গল্প ও অনুজদের জন্য পরামর্শ শুনিয়েছেন। আমরাই বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য ইমদাদ হোসেন বিপুল-এর সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হল-

জীবনের শুরুর গল্পটা কেমন ছিল?
ইমদাদ হোসেন বিপুল: এসএসসি পরীক্ষার আগেও আমি সাধারণ চিন্তা-ভাবনা নিয়ে চলতাম। ভেবেছিলাম যা করছি, তাই করে যাই। কোনো রকমে পড়াশুনা শেষ করে একটা চাকরি পেলেই হবে। এসএসসি পরীক্ষার আগে ক্যারিয়ার নিয়ে খুব বেশি উচ্চাকাঙ্খা ছিল না। ভাবনাও ছিল সীমাবদ্ধ। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার পর দেখলাম আমার সমমানের সহপাঠীরা আমার চেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে। তখন আমার চিন্তার পরিবর্তন হলো। আমি খেয়াল করলাম, পড়াশুনা নিয়ে সিরিয়াস থাকার কারণেই আমার চেয়ে সহপাঠীদের রেজাল্ট ভালো। এরপর আমি এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য পড়াশুনা শুরু করলাম। এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট হলো।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পড়াশুনা শুরু করলাম। প্রথমবার পাবনা বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের একটি বিভাগে ভর্তি হলাম। পরের বছর আবারও ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেলাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি)। পরিবারের আর্থিক সংগতি ভালো ছিল না। পাবনায় গিয়ে পড়ার চেয়ে নিজ শহর কুষ্টিয়াতে থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যাপারে বাসা থেকে আমাকে বলা হলো। আমিও পরিবারের কথা ভেবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং বিভাগে ভর্তি হই।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতি সম্পর্কে কিছু বলুন।
ইমদাদ হোসেন বিপুল: অন্যসব সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতোই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি। তবে নিজ শহর কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে নিয়মিত বাসে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করতাম। ফলে ক্যাম্পাসের বাস কেন্দ্রিক আমার একটা সার্কেল তৈরি হয়েছিল। আমরা ক্যাম্পাসমুখী ও ক্যাম্পাস থেকে ফিরতি বাসগুলোতে নিয়মিত আড্ডা দিতাম। অনেকে বাসে গলা ছেড়ে গান গাইতো, আমিও মাঝে মাঝে গলা মেলাতাম। কুষ্টিয়ার ছেলে হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক সুবিধা পায়নি। এ ছাড়া রাজনৈতিক পরিচয় না থাকায় হলে সিটের জন্য লবিং করতেও ইচ্ছা করেনি। তবে হলে একবার সিট হয়েছিল। হল প্রভোস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য গেলাম। আমাকে বলা হয়েছিল, কুষ্টিয়ার মানুষ হলে থাকবেন কেন? বাসা থেকেই তো যাতায়াত করতে পারেন। এরপর আর হলে সিটের জন্য চেষ্টা করিনি। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, জাতীয় দিবস ও উৎসবগুলো দারুণ ভাবে উপভোগ করেছি। যা সারাজীবন আমার স্মৃতি হয়ে থাকবে।

আপনার সফলতার পেছনে পরিবার ভূমিকা কেমন ছিল?
ইমদাদ হোসেন বিপুল: পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েন ছিল চরমে। তবে তা আমি বাইরের কাউকে বুঝতে দিইনি। ক্যাম্পাস থেকে ফিরে একাধিক টিউশনি করিয়ে নিজের খরচ জোগাড় করেছি। পরিবার থেকেও সহযোগিতা নিয়েছি মাঝেমাঝে। আমার বাবা শারীরিক অক্ষমতার জন্য সরকারি চাকরি (সেনা সদস্য) থেকে স্বেচ্ছা অবসর নেন। এরপর আমাদের পরিবারে অভাবের সঙ্গে শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। বাবা নিরূপায় হয়ে কুমারখালী পৌরসভায় ছোটোখাটো একটি চাকরি নেন। সেখানেও নিয়মিত বেতন হতো না। টাকার অভাবে আমরা অনেক কষ্ট করেছি। অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি। কিন্তু কখনো বন্ধুদের বুঝতে দেইনি। আমার বাবার টাকা পয়সা তেমন না থাকলেও তিনি বরাবর আমাকে সাহস দিয়েছেন। সৎ থেকে সৎভাবে জীবিকা নির্বাহ করার জন্য তিনি বারবার আমাকে তাগাদা দিয়েছেন। জীবনের কঠিন সময়ে টিকে থাকার জন্য আমার মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যরা সহযোগিতা করেছেন।

সফলতার গল্পের শুরুটা কেমন ছিল?
ইমদাদ হোসেন বিপুল: বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আমি তখন তৃতীয় বর্ষে। বন্ধুদের কেউ কেউ বিসিএস, ব্যাংক ও অন্যান্য চাকরির প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। আমিও বন্ধুদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে চাকরির প্রস্তুতির জন্য পড়াশুনা শুরু করলাম। এরপর ৩৭তম বিসিএসে প্রিলিমিনারিতে অকৃতকার্য হলাম। তারপর ৩৮তম বিসিএস দিলাম। প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। পরে ৪০তম বিসিএসে মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। কিন্তু ৪০তম বিসিএসের ফলাফল বের হওয়ার আগেই ৩৮তম বিসিএসে আমি কাঙ্খিত পদের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হই। আমি আমার সীমিত স্বপ্নের ছোঁয়া পেয়েছি। মহান সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই।

অনুজদের জন্য আপনার পরামর্শ?
ইমদাদ হোসেন বিপুল: স্বপ্ন একেকজনের একেক রকম। আমার স্বপ্ন পূরণের যে সংগ্রাম, তার সঙ্গে অনেকেরই মিলবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই-বোনদের বলতে চাই, জীবনে কিছু অর্জন করতে হলে অবশ্যই কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। অল্পতেই হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়া চলবে না। তথ্যের সঙ্গে আপডেট থাকতে হবে। সফলতা না আসা পর্যন্ত নানা মানুষ নানান কথা বলবে। সবার সব কথা মাথায় নিয়ে নিজেকে ছোট ভাবা উচিত চলবে না। নিজের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। বাস্তবতা বুঝে চলা শিখতে হবে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ইতিবাচক মানসিকতা। উচ্চতর ডিগ্রি থাকলেই ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি হয় না। এটি নিজের মন-মননে তৈরি করে নিতে হয়। অনুজদের বলতে চাই, প্রত্যেকটা মানুষ নিজ নিজ পরিমণ্ডলে সফল। কাজেই নিজের অবস্থানকে অন্যের অবস্থানের সঙ্গে মেলানো ঠিক হবে না। সর্বদা সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করতে হবে।

 

এবি/এসএন

০৪ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:১৭পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।