• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কৃষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অদম্য আসিফ

কৃষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অদম্য আসিফ

ছবি: আসিফ ইকবাল আরিফ

শাহজাহান নবীন

নানা চড়ায়-উতরায় পেরিয়ে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকে মানুষ। কণ্টকাকীর্ণ পথ মাড়িয়ে চকচকে সফেদ সড়কে পা ফেলতে পারেন যারা, তারাই যেন সফল। প্রতিকূল পরিবেশ, সুযোগের অভাব ও প্রতিবন্ধকতা জয় করে যারা জীবন-সংগ্রামে সফল হয়েছেন, তাদের মধ্য থেকে আমরা কিছু তরুণ সফল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা তাঁদের অভিব্যক্তি ও জীবনের গল্প শুনিয়েছেন।

আজকের পর্বে আমাদের সঙ্গে রয়েছেন ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আসিফ ইকবাল আরিফ। আমরাই বাংলাদেশ’কে দেয়া তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিচে তুলে ধরা হলো-

জীবনের শুরুর গল্পটা যদি বলতেন:

আসিফ ইকবাল আরিফ: জীবনের শুরুটা যেখান থেকে শুরু হয়েছিলো সেখানে অনেক বেশি সংগ্রাম ছিলো। আমার আব্বা ছিলেন একজন ছোটখাটো কৃষক। আমার আব্বার পরিস্থিতি এমন ছিলো যে, না সে নিজের জমি চাষ করে সংসার চালাতে পারতো, না সে এক নাগাড়ে অন্যকাজ করে সবকিছু সামলাতে পারতো। যাইহোক, একটু একটু করে যখন বেড়ে উঠেছি, তখন থেকেই জীবনের স্বপ্নের সীমানা বড় হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই আমি খুব স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করতাম নিজেকে নিয়ে। তবে আমার দেখা স্বপ্ন আব্বা-মাকে বলার সাহস পেতাম না।
স্কুল জীবন বলতে যতদূর মনে পড়ে আমি খুব সম্ভবত প্রথম শ্রেনি থেকে পঞ্চম শ্রেনি পর্যন্ত নিয়মিত স্কুলে গিয়েছি। তারপর বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ছাড়া স্কুলে তেমন যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আমাদের কৃষি গৃহস্থালীর অনেক কাজ আমাকে করা করা লাগতো। বাড়ি ও মাঠের কাজেই আমার বেশি সময় গিয়েছে। আমার কোনো সহোদর ভাই ছিলো না। তাই আব্বার কাজের সঙ্গী ও সহযোগী একমাত্র আমিই ছিলাম।

লেখাপড়ার ধারাবাহিকতায় ফিরলেন, সিদ্ধান্তটি কঠিন ছিল। নেপথ্যে সহযোগিতার গল্পটুকু কেমন ছিল:

আসিফ ইকবাল আরিফ: এইভাবে আমি নবম শ্রেনির অর্ধেক পার করেছি। তবে মজার একটি ঘটনা ঘটে গেলো নবম শ্রেনিতে পড়ার মাঝামাঝি সময়ে। একদিন আমি একেবারে রাস্তা সাথে ঘেঁষা আমাদের ধানের জমিতে কাজ করছি। মাথায় খুব সম্ভবত মাথাল অথবা গামছা বাঁধা ছিলো। একজন ভদ্র লোক বয়স চল্লিশের মতো হবে। উনি বাইসাইকেল থেকে নেমে আমাকে ডাকলেন। উনি আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি পরিচয় দিয়ে আমার কাজ করে যাচ্ছিলাম। পরে উনি খুব আফসোস নিয়ে বলে বসলেন, “এতো সুন্দর একটা ছেলের মাথায় কি না মাথাল”? উনি চলে গেলেন। তবে আগন্তুক পথিকের চলে যাওয়ার পরে তাঁর বাক্যটি আমাকে খুব আহত করেছিলো। তাঁর একটি বাক্য আমাকে জাগ্রত করেছিল। আমি ওইদিন আর কাজ করলাম না। বাড়ি চলে গেলাম।

আমি বাড়ি ঢুকতেই দেখি আমাদের বাড়ির উপর আমার আব্বা, দুরসম্পর্কের এক দাদা, আর আমার এক বোন জামাই কি নিয়ে যেনো আলাপ করছে। আমি সেখানে গিয়ে অবগত হলাম যে তারা আমার লেখা পড়া এবং শিক্ষা জীবন নিয়ে আলাপ করছে। আমার বোন জামাই আর ঐ দাদা বারেবার আব্বাকে সাহস দিয়ে চলছিলো। আব্বার মুখ দেখে সেই সময় মনে হচ্ছিলো যে, আব্বা মূলত দুইটি বিষয় নিয়ে খুব সঙ্কিত ছিলেন।

প্রথমত, আমাকে লেখাপড়া করাতে গেলে লেখাপড়ার খরচ যোগানো তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। দ্বিতীয়ত, আমি নিয়মিত স্কুলে গেলে আমাদের কৃষিকাজ সামলানো আব্বার পক্ষের কষ্টসাধ্য হয়ে যেতো। এমনিতে আমার বড় দুই বোনকে শ্বশুর বাড়ি দিয়ে আমাদের পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো সেই সময়। ঠিক এমন সময় গৃহস্থালী থেকে একজন উৎপাদন সক্ষম শ্রম শক্তি পুরোপুরিই অন্য জীবনের দিকে যাচ্ছে – এই নিয়ে আব্বাও এক অন্যরকম বাস্তবতার সম্মুক্ষীন হয়েছিলো। এক সময় আব্বা রাজি হলো। পর দিন থেকে আমি স্কুলে নিয়মিত হয়ে গেলাম। এর আগে স্কুলে আমি সব বিষয়ে পাশ করলেও গণিতে পাশ করতে পারিনি। তাই সকাল বিকাল গণিত প্রাইভেট পড়তে হতো স্কুলে ক্লাশের পাশাপাশি।

আমার আব্বা সেই সময় প্রায়ই স্কুলে যেতেন আমার খবর নিতে। আমি রামচন্দ্রপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম। এটি আমার নিজ জেলা ঝিনাইদহের সদর উপজেলার হলিধানী ইউনিয়নে অবস্থিত। আব্বার এমন আসা-যাওয়া দেখে ওই স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ দিয়েছিলো। শুধু তাই নয়, দুইজন শিক্ষক আমাকে বিনা বেতনে প্রাইভেট পড়াতেন। মোস্তফা স্যার ইংরেজি পড়াতেন। আর তোফাজ্জেল স্যার আমাকে হিসাববিজ্ঞান পড়াতেন।

এরপর ২০০৭ সালে যখন এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পাশ করলাম। আমি সেই বছর আমার স্কুল থেকে সর্বোচ্চ জিপিএ পেলাম। জিপিএ–৫ না পেলেও আমি আমার জীবনের নতুন এক স্বপ্নের পথে হাঁটতে শুরু করলাম। এরপর ২০০৯ সালে এইচএসসি পাশ করলাম। সেই বারও জিপিএ–৫ না পাওয়া আমি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে আমার টোটাল স্কোর সেই সময় ফেলে দেওয়ার মতো ছিলো না। শুরু হলো জীবনের নতুন যুদ্ধ।

সফল ক্যারিয়ারের স্বপ্ন দেখার শুরু কখন:

আসিফ ইকবাল আরিফ: আমি ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে দুইটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪টি অনুষদে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলাম। কিছুদিন পড়লাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও আইন বিভাগে। তারপর দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় ২০১০-১১ সেশনে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানে ভর্তি হলাম। পরে মাইগ্রেশন করে নৃবিজ্ঞানে ভর্তি হলাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরেই মূলত জীবনের স্বপ্ন বড় হতে লাগলো। এইদিকে যেমন আমার স্বপ্ন বড় হচ্ছিলো ঠিক তেমনি অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিলো আমার আব্বা আর মায়ের কষ্ট। মূলত আর্থিক যোগান দেওয়া তাদের জন্যে অনেক কষ্টসাধ্য ছিলো সেই সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। পরে তা বিয়েতে রূপ নেয়। এতে মূলত আমার থেকে আমার আব্বা-মা আর আমার স্ত্রীর আগ্রহই বেশি ছিল। বিয়ের পরে নিজের উপর চাপ বাড়লো। এইবার অন্তত একটা দুইটা টিউশনি করতে হবে। একটা টিউশনি পেয়েও গেলাম। আমার স্ত্রীও টিউশনি করতো একটা। এইভাবে এক মাস পেরোতে না পেরোতেই অনার্স প্রথম বর্ষ প্রথম সেমিস্টারের ফল বের হলো। আমি সেরা চারে ছিলাম। তারপর থেকে আমি আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। এইবার আমার জীবনের একটি স্বপ্ন স্থির হতে লাগলো। আর তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া। আমার স্ত্রী রিপাও পড়তো আমার সাথেই। নৃবিজ্ঞানে।

এরপর আমি আমার সমস্ত মনযোগ পড়াশুনায় দিলাম। জীবনের নানান সংকট মূলত পারিবারিক চাপ মাথায় নিয়েই অনার্স শেষ করলাম ব্যাচের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সিজিপিএ নিয়ে। তারপর আরও অবাক করা একটি ফলাফল আসলো মাস্টার্সে। আমি আর আর আমার স্ত্রী রিপা সর্বোচ্চ সিজিপিএ নিয়ে দু’জনে যৌথভাবে প্রথম হলাম। তারপর আমি নৃবিজ্ঞান বিভাগে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. জাহিদুল ইসলাম স্যারের একটি প্রজেক্টে কিছুদিন চাকরি করলাম। তারপর ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি. গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ এ চাকরি শুরু করি। এরপর ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করলাম। আমি আমার সেই স্বপ্নের পেশাতে বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত আছি। এমনকি বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে বিভাগের প্রথম বিভাগীয় প্রধান হিসেবে আমি আছি।

আমার যে এই বর্তমান- তা দাঁড়িয়ে আছে আমার আব্বা আর মায়ের নিরলস মানিয়ে নেওয়া কষ্টের ওপর। আমি আমার সেই দুরসম্পর্কের দাদা আর আমার বোন জামাইয়ের কাছে ঋণী, যারা মানসিক সাপোর্ট দিয়ে আমার আব্বাকে অন্যভাবে গড়েছিলেন আমার ভাগ্য বদলাতে। তবে মাঠের রাস্তায় যেই আগন্তুক আমাকে ডেকে বলেছিলেন ‘এত সুন্দর ছেলের মাথায় কি না মাথাল’; আমি বারবার সেই আগুন্তককে স্মরণ করতে চাই। আমি বহুবার তাকে খুঁজেছি, পায়নি। আমি হৃদয় থেকে তাঁর জন্য দোয়া করি, শুভ কামনা করি। তিনি আমার মনকে জাগ্রত করে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া আমি খুব করে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে চাই আমার স্কুলের সেই শিক্ষকদের প্রতি। সর্বোপরি, আমার এই স্বপ্নের পেশাতে আসতে যে সকল মানুষ আমাকে তাদের প্রজ্ঞা এবং ভালোবাসা দিয়েছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। এর মধ্য রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ, কবি জসীম উদ্দীন হলের বন্ধু এবং সিনিয়ররা।

এখন কী করছেন, কী কী করতে পছন্দ করেন?

আসিফ ইকবাল আরিফ: জীবনের বিশেষ অর্জনের খাতায় এখনো তেমন কিছু যোগ করতে পারি নি। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের প্রচেষ্টাতে আছি যাতে করে আমি আমার নিজেকে এবং আমার শিক্ষার্থীদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারি। বাংলাদেশের নৃবিজ্ঞানের জন্যে কাজ করতে পারি।

শিক্ষকতার পাশাপাশি আমি লেখালেখি করি। গল্প আর কবিতা লিখতে আমার ভালো লাগে। মাঝে মাঝে গানের কথা লিখি। ২০২১ সালে অমর একুশে বইমেলাতে আমার প্রথম গল্প গ্রন্থ ‘ফুলের রাত, দ্বিধার রাত’ প্রকাশিত হয়েছে। আগামী ২০২২ সালে অমর একুশে বইমেলাতেও ‘পলকা’ নামে আরও একটি গল্প গ্রন্থ প্রকাশিত হবার পথে আছে। আমার ঘুরতে খুব ভালো লাগে। বাগান করতে খুব ভালোবাসি। একটু সুযোগ পেলেই আমি মাটি আর শেকড়ের সাথে লেগে থাকি।

ক্যারিয়ারে আপনার সফলতা কতটুকু:

আসিফ ইকবাল আরিফ: ক্যারিয়ার কতটুকু সফল হয়েছি তা আমি জানি না। তবে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি সফল হবার। যদিও সফলতা এবং বিফলতা আপেক্ষিক বিষয়। তবে আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এই জায়গা থেকে গল্প বলা খুব সহজ। তবে এই জায়গাতে পৌছানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না স্বপ্ন ছাড়া। আমার আব্বা আর মায়ের দোয়া ও স্ত্রীর সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া আমি আজকের অবস্থানে পৌছতে পারতাম না। আর হ্যাঁ। আমার একটা মেয়ে আছে। ওর নাম আলভিনা। বয়স তিন বছরের একটু বেশি হয়েছে। ওকে নিয়ে খুব ভালো সময় পার করছি।

অনুজদের জন্য আপনার পরামর্শ:

আসিফ ইকবাল আরিফ: আমি আমার জীবনে যে বিষয়টিকে সব থেকে বেশি পূজো করে চলি তা হচ্ছে পরিশ্রম। আমি পরিশ্রম করতে ভালোবাসি। আর হয়তো এই পরিশ্রমই আমাকে দাঁড় করিয়েছে আজকের এই জায়গাতে। পেশাজীবনেও চেষ্টা করি সেটা ধরে রাখার। কে জানে আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আমি নিজের কথা স্বল্প করে লিখছি একদিন এর থেকেও বড় করে কেউ হয়তো লিখবে।

 

এবি/এসএন

২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ০৪:২৩পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।