• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কূটনীতি ও পিনাকীর টক শো

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কূটনীতি ও পিনাকীর টক শো

সেন্ট্রাল ডেস্ক

জুলাই-আগস্টের ছাত্র জনতার দুর্বার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। আন্দোলনের নাম এখন ‘২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থান’। অভ্যুত্থানের আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সরকারের নানা বিতর্কিত ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশবিদেশে সমালোচনা হয়েছে। সমালোচকদের অন্যতম একজন ডা. পিনাকী ভট্টাচার্য। ইউটিউব ও ফেসবুকে ভিডিও এপিসোডের মাধ্যমে শেখ হাসিনার দুঃশাসনের নানা দিক নিয়ে তিনি ধারাবাহিক ভাবে সমালোচনা করে গেছেন।

ছাত্র জনতার আন্দোলনের নেপথ্য কারিগরদের অন্যতম একজন হিসেবে ডা. পিনাকীর নাম অনেকেই বলে থাকেন। সম্প্রতি তিনি তার ইউটিউবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান, হাসিনা আমলে ভারত-বাংলাদেশ কূটনীতি ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কূটনীতি নিয়ে টক আয়োজিত হয়। টক শোতে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ড. খলিলুর রহমান।

আমরাই বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য টক শো আলোচনাটি হুবহু তুলে ধরা হল-

পিনাকী ভট্টাচার্য: বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করব। আলোচনার আগে আজকের অতিথির সম্পর্কে আপনাদের জানাতে চাই। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের সদস্য হিসেবে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক কমিটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন খলিলুর রহমান। ১৯৯১ সালে তিনি বিশেষ উপদেষ্টা পদে জাতিসংঘ সচিবালয়ে যোগদান করেন।

এছাড়া গত তিন বছর ধরে আমি প্রত্যেকটি এপিসোড করার আগে খলিলুর রহমানের সাজেশান্স ও গাইডেন্স নিয়েছি। এবং আমার এপিসোড প্রকাশের পর প্রথম তাকেই ফোন করে জানতে চাইতাম, কেমন হয়েছে আমার এপিসোড? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি আমার এপিসোডগুলোকে ভালো বলেছেন। তিনি আমার এডিসোডগুলোর সমালোচনাও করেছেন। অনেকেই বলেছেন, আমার বিধ্বংসী এপিসোডের জন্য আমি নাকি অর্জুন। আমি যদি অর্জুন হয়ে থাকি, তাহলে খলিল শ্রী কৃষ্ণ। খলিল ভাই, আপনাকে স্বাগত।

খলিলুর রহমান: আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অজস্র ধন্যবাদ। আপনি আমাকে যেভাবে বললেন, আমি সেটা না। আপনিই এই গণঅভ্যুত্থানের অর্জুন। বাংলাদেশের এই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক আপনি। আপনি যেভাবে কাজ করেছেন, তা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত ইফেকটিভ ছিল। আমি দেখেছি, আপনি আমাকে অনেক সময় ফোন করেছেন। রাত ৪টার সময়ও আপনি ফোন করেছেন। আপনি এই আন্দোলনের সফলতার জন্য বহু রাত পরিশ্রম করে কাটিয়েছেন।

আরেকটা কথা বলব, আপনি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক ফ্যাসিজম, রাষ্ট্র ও সরকারের অর্গানগুলোর ফ্যাসিবাদী রূপ খুব সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। এটা অনেক কঠিন কাজ। সবাই এটা এত সহজ ভাবে করতে পারে না, যেটি আপনি সম্ভব করেছেন। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এই বিষয়গুলো জানা বোঝা অত্যন্ত জরুরি। আর এই মানুষকে জানানো এবং তাদেরকে বুঝানোর যে কঠিন কাজ, সেটিই আপনি করে গেছেন। আপনার প্রতিটি ভিডিওতে মানুষ সাড়া দিয়েছে। আপনি মানুষকে ফ্যাসিবাদী শক্তি হটাতে এক কাতারে শামিল করেছেন। গণঅভ্যুত্থানের এই বিজয়ের ইতিহাসে আপনার নাম স্বর্ণাক্ষরেই লেখা থাকবে।

আলোচনার আগে, এই গণঅভ্যুত্থানে যারা শহিদ হয়েছেন, তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে চাই। আহত ও পঙ্গুত্ববরণকারী গণতন্ত্রকামী সকল বীর যোদ্ধাদের আমি সহমর্মিতা জানাতে চাই। এবং সকল বিজয়ী বীরদেরকে জানাচ্ছি মোবারকবাদ। আমি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। আমার ছাত্ররাও আন্দোলনে অবদান রেখেছেন। আমি তাদেরকে বিশেষ ভাবে স্মরণ করতে চাই।

আপনার প্রশ্নে আসি, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকালে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক ছিল তা স্বাভাবিক ছিল না। দুটি স্বাধীন দেশের মধ্যে যে দেয়া নেয়া বা বোঝাপড়ার কুটনৈতিক সম্পর্ক থাকার কথা, সেটা ছিল না। বরং, ভারতের সাথে শেখ হাসিনার বিশেষ একটি বন্দোবস্ত ছিল। মোটা দাগে এটাই ছিল ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রকৃতি।

এবং এই সম্পর্কের টার্মস অব এনগেজমেন্ট ছিল, ভারত শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি সবসময় নিশ্চিত করবে। আর শেখ হাসিনা ক্ষমতার নিশ্চয়তার বিনিময়ে ভারতের সকল স্বার্থ নিশ্চিত করবে। সেটা শেখ হাসিনার কথার মাঝেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমি ভারতকে যা দিয়েছি, তা চিরকাল ভারত মনে রাখবে। কিন্তু তিনি বলতে পারেননি, আমি ভারত থেকে যা এনেছি, তার দেশের মানুষ সারাজীবন মনে রাখবে। তিনি বলতে পারেননি, বাংলাদেশের সকল নদীর জন্য পানি ন্যায্য হিস্যা আদায়, সীমান্ত হত্যা বন্ধ ও ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের অবাধ রপ্তানির ব্যবস্থা করতে পেরেছি।

শেখ হাসিনার সমর্থকরা কার্যত ভারতের প্রতি অনুগত ছিল। শেখ হাসিনা ও ভারতের টার্মস অব এনগেজমেন্টে এসব ছিল না। শেখ হাসিনার অনুগতরা ভারতের স্বার্থের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। কার্যত শেখ হাসিনা ও তার অনুসারীদের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ গৌণ ছিল বলে প্রতীয়মান হয়েছে। শেখ হাসিনা ও ভারতের এই সম্পর্ক কংগ্রেস আমল থেকে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকা সফর করেছিলেন। তিনি এরশাদকে ঘাড় ধরে নির্বাচনে নিয়েছিলেন। যেটা সবাই দেখেছে। সেটা কিন্তু হাসিনা-ভারত সম্পর্কের সূচনা লগ্নের ঘটনা।

গত নির্বাচনের সময় বাইডেন প্রশাসন সোচ্চার ছিল। তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছিল। কিন্তু আমেরিকার সেই প্রচেষ্টা ভারত ডামি নির্বাচনের থিওরি দিয়ে ভন্ডুল করে দিয়েছিল। আর এসব দেখেই আমরা বুঝতে পেরেছি, হাসিনা ও তার অনুসারীরা বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতি চরম উদাসীনতা দেখিয়েছে।

এজন্য শেখ হাসিনার দলের এক প্রার্থী ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, আমি নৌকার প্রার্থী, ভারতেরও প্রার্থী। ভাবা যায় এ কথা। কেবল এই বিশেষ বন্দোবস্ত থেকে কেবল বাংলাদেশ বঞ্চিত হয়েছে তা নয়, বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় মর্যাদা বিঘ্নিত হয়েছে। আমাদের দেশের মানুষের বাক স্বাধীনতা, অধিকার, ভোটাধিকার ধ্বংস করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কেবল বাংলাদেশ রাষ্ট্র নয়, গোটা দেশের মানুষের সকল অধিকার বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

হাসিনা সরকার বিগত বছরগুলোতে নির্যাতন, মামলা, গুম-খুনের যে নৈরাজ্য যে ভয়াবহতা দেখিয়েছে, তা বিশ্বেও ইতিহাসে বিরল। আয়নাঘরের লোমহর্ষক সৃষ্টি হাসিনার। ভাবা যায়? হাসিনার আয়নাঘর ও নাৎসিদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। আয়নাঘরে যারা নির্যাতন করত তারাও আমাদের দেশেরই মানুষ, তারা কীভাবে এগুলো করেছে আমি ভেবে পায় না। এগুলো মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়।

দেশের অর্থনীতির কথা কি আর বলব। চিন্তা করে দেখুন। কত লক্ষ কোটি ডলার তারা বিদেশে পাচার করেছে। বিদেশে তারা সেকেন্ড হোম বানিয়েছে। দেশের উন্নয়নের নামে অপ্রয়োজনীয় প্রজেক্ট বানিয়ে তারা হাজার হাজার কোটি ডলার পাচার করেছে। সংঘবদ্ধ ভাবেই তারা এই অপকর্ম করেছে। হাসিনা ও তার অনুসারীরা দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। তবে যাই বলেন না কেন, এত আটঘাট বেঁধেও হাসিনা কিন্তু ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারলেন না। তাকে চরম অপমান অপদস্থ হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে স্বৈরাচারের মুকুট মাথায় নিয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে। তাকে চোরের মতো পালিয়ে যেতে হয়েছে, যখন তার হাজার হাজার নেতাকর্মী দেশে পড়ে আছে। এরশাদও কিন্তু দেশ ছেড়ে যাননি। সবচেয়ে বড় কথা, হাসিনাকে ভারতও এখন আর হজম করতে চাইছে না। ভারত সম্পর্কে দেশের মানুষের যে ভয়-ভীতি ছিল, সেসবও কিন্তু কেটে গেছে।

এখন কথা হলো- এটা ভারত-হাসিনার পররাষ্ট্রনীতির জন্য বড় একটি ধাক্কা।

ভারত-বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে

দেখুন, ভারত কিন্তু বুঝে গেছে হাসিনা বিদায় নেয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশে অনেক কিছু বদলে গেছে। বাংলাদেশ সামনের দিনগুলোতে আরও বদলে যাবে। ভারত হাসিনাকে দিয়ে যেমন বাংলাদেশ বানিয়ে রেখেছিল, সেটা কিন্তু শেষ হয়ে গেছে। এখন নতুন বাংলাদেশ। কাজেই ভারতকেও বাংলাদেশ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। ভারতে অনেক বিজ্ঞ ও জ্ঞানী মানুষ রয়েছে, আমার বিশ্বাস তারা হাসিনা নয় বরং বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারবে। যদি তারা এটা বুঝতে সক্ষম হয়, তাহলে ভারত-বাংলাদেশ সকলের জন্যই কল্যাণকর। বাংলাদেশের এই পরিবর্তন ভারত মেনে নিলে দুই সম্পর্ক দীর্ঘতর, টেকসই ও পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হবে। আর ভারত যদি বাংলাদেশের এই পরিবর্তন মেনে নিতে না পারে, তাহলে বাংলাদেশের কূটনীতিতে অন্য কোনো শক্তি ঢুকে পড়বে। সেটা ভারত সম্ভবত চাইবে না। তবে যাই বলুন না কেন, হাসিনার এই পতন দিনশেষে ভারতেরই নীতি বিপর্যয়।

হাসিনার এই পতন ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন মোদি সরকারের জন্যও বিপর্যয় বটে। কারণ মোদি কিন্তু এখন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ক্ষমতাসীন না। কোয়ালিশন সরকার গড়েছে মোদির বিজেপি। আমরা দেখেছি, ভারতের কোয়ালিশন সরকারগুলোর অবস্থা কেমন হয়েছে অতীতে। এখন বাংলাদেশে ভারতের এই নীতি বিপর্যয় দিল্লি সহজে মেনে নেবে না। বাংলাদেশের এই পরিবর্তনকে পরিকল্পিত অস্বীকৃতি বা ‘ক্যালকুলেটেভ ডিনাই’ চালাবে ভারত। এরই মধ্যে ভারত তাদের এই কাজ শুরু করেছে। ভারতের সাবেক বড় বড় কূটনীতিকরা নানা ভাবে বাংলাদেশের এই পরিবর্তনকে অস্বীকার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশে যখন আন্দোলন তুঙ্গে, তখন ভারতের অনেক বুদ্ধিজীবীও আন্দোলন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। যা আমরা দেখেছি।

ভারত বারবার বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণঅভ্যুত্থানকে মৌলবাদীদের আন্দোলন হিসেবে ট্যাগ দিতে চেয়েছে। তারা সেই অপচেষ্টা এখনো অব্যাহত রেখেছে। ভারতের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে বারবার বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আফগানিস্তান হয়ে যাচ্ছে। তালেবানের হাতে চলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এমনকি রাহুল গান্ধী আমেরিকায় গিয়ে সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশে ফের উগ্রপন্থার উত্থান হচ্ছে। ভারতের রাহুল গান্ধী কিংবা নরেন্দ্র মোদি, তারা সবাই বাংলাদেশের এই পরিবর্তনকে মৌলবাদী উত্থান হিসেবে ট্যাগ দিতে মরিয়া। এটা আমরা সবাই দেখছি। ভারতের এই অবস্থান তাদের হয়ত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ থেকে দূরে ঠেলে দিতেও পারে। তবে রাহুল গান্ধীদের এমন মন্তব্যে আমরা অবাক নই। বাংলাদেশ ও ইসলাম নিয়ে তাদের একটা ফোবিয়া আছে। সেই জায়গা থেকেই রাহুল গান্ধী বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে এমন হাস্যকর মন্তব্য করেছেন।

বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের ভয় কিসে?

বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের ভয় নেই। আছে স্বার্থ। সেটা হচ্ছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার স্বার্থে ভারত সবকিছু সাজিয়েছিল। কিন্তু সব এখন ভেঙে পড়েছে মুখ থুবড়ে। ভারতের এই স্বার্থবাদী ডিপলো ম্যাসি টিকলো না। এগুলো আসলে টিকে না। কখনোই টিকে। মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে, কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়ে, নির্যাতন চালিয়ে কোনো স্বাধীন দেশকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো ভুল করেছে ভারত। যার খেসারত তাদের দিতে হচ্ছে।

ভারত আমাদের সরকারকে নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছিল। কিন্তু তারা আমাদের জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কারণ, ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করা একটি জাতিকে আন্দোলন দমনের ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখা অসম্ভব। এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ ছাড়া আর একটি দেশও নেই যাদের লড়াই সংগ্রামের এমন উজ্জ্বল ইতিহাস আছে। আমার দেশের মানুষ লড়াই করেই টিকে আছে। লড়াই করেই আমার দেশের মানুষ বাঁচে। আন্দোলন কী, অভ্যুত্থান কী, এগুলো অনেক দেশ জানেই না। যেমন ভারতও জানে না এমন আন্দোলন কাকে বলে। আর ঠিক এ কারণেই তারা কাশ্মির স্টাইলে বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। এটাই ভারতের ভুল, মস্ত বড় ভুল।

পিনাকী ভট্টাচার্য: আপনি কিন্তু অনেক আগে বলেছিলেন, এটি টিকবে না। কখনোই টিকবে না। এই যে জিনিস টা, সাসটেনেবল না, এটা কেন তারা আগে বুঝল না। তারা টিকবে না, এটা সবাই বুঝলেও তারা বুঝেনি। এত ডিপ্লোমেসি এত কিছু শিখে তাদের লাভ হল কি?

খলিলুর রহমান: ভাই, নিজের বাহাদুরি আমি জাহির করছি না। তিনটা বছর ধরে আমি এই একই কথা বলে আসছি। আপনি আমাকে জানতে চেয়েছিলেন প্রথমেই। ভাই, এইটা টিকবে? আমি বলেছিলাম, না এটি টিকবে না। এটা টিকার জিনিস না, আমি এরকম জিনিস টিকতে দেখি নাই, এগুলো হয় না। একটা স্বাধীন রাষ্ট্রকে আপনি এভাবে ট্রিট করতে পারেন না।

পিনাকী ভট্টচার্য: আপনার সেই টোন টা এখনো আমার কানে বাজে। ভাই, এটা টিকবে এ এ না। হাসি। কিন্তু তারা এইটা বুঝতে পারল না। মানে ধরেন যে, মানুষ চরম ভাবে ভারত বিরোধী হয়ে উঠছে। এই রেজিমটা এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যেকোনো মুহূর্তে এটা কলাপস করবে, এটা তারা বুঝতে পারল না। এর মধ্যে আমরা আবার ভারতীয় পণ্য বয়কটের আন্দোলন করলাম। এটা তুমুল ভাবে জনপ্রিয় হয়ে গেল, তারপরও তারা কেন বুঝতে পারল না?

খলিলুর রহমান: আপনাকে বলি। অজনপ্রিয়তা একটা বিষয় আছে। আপনি মানুষের অধিকার কেড়ে নিবেন, মানুষের কথা বলা অধিকার কেড়ে নিবেন, গণতন্ত্র কেড়ে নেবেন, মানুষ বসে বসে আঙুল চুষবে না। মানুষ অত্যাচারিত হবে, নির্যাতিত হবে, মানুষ মেনে নেবে এটা তো মেনে নেবে না মানুষ। এটা তো মেনে নেয়া যায় না। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কিন্তু এই উপমহাদেশের একমাত্র দেশ, যারা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা পেয়েছে। কোনো আলোচনার টেবিলে বসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসেনি। এবং আপনি লক্ষ্য করবেন, বাংলাদেশের প্রতিটি প্রজন্ম একটি বড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি, সেই সময় আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন হলো। আমরাও ফারহানের মতো রাস্তায় নেমেছি। পাকিস্তান আমাকে গুলি করে নাই, কিন্তু তারা ফারহানকে গুলি করেছে।

আজকে এত বড় একটা আন্দোলন, এরকম লড়াকু মনোভাব এই উপমহাদেশের আর কোনো দেশের নেই।

পিনাকী ভট্টাচার্য: এইটা আমি আমার এপিসোডেও বলেছি। রাষ্ট্র কি, রাষ্ট্র বিপ্লব কী, অভ্যুত্থান কী, আন্দোলন কী এইসব জিনিস ভারতের লোকজন জানে না। ভারতীয়দের হাইট অব থিঙ্কিং এ্যাবাউট রেভুলুউশন ইজ অনলি নকশাল। আমরা কিন্তু ভারতীয়দের এই চিন্তাকেও স্যালুট জানাই। তবে এখন পর্যন্ত, ভারতের নকশাল মুভমেন্ট আমাদের যেকোনো একটা ছোটখাটো আন্দোলনের সাথেও তুলনা চলে না।

খলিলুর রহমান: এখন আপনি বললেন যে, ভারত এই কাজটা করল কেন? এর একটা ইতিহাস আছে। এই ইতিহাস আমি আমার শিক্ষকের কাছ থেকে জেনেছি। তিনি মেন্টর ছিলেন। হুমায়ুন রশিদ চৌধুরি সাহেব। উনি যখন ফরেন মিনিস্টার ছিলেন, এবং ব্যারিস্টার একেএইচ মোর্শেদ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইনার চেয়ে বড় পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব আর কেউ ছিলেন না। এখন পর্যন্ত কেউ আসেনি। এই সব মানুষের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি।

১৯৬২ সালে চীন ভারত আক্রমণ করে। এবং সেই সময় চীনা সৈন্যরা এক পর্যায়ে আসামে ঢুকে যায়। তো তখন আকাশবাণী তে বিজেন বোস নামে একজন খবর পড়তেন। উনি, এভাবে বললেন, আসামে আমাদের সৈন্যরা সম্মানজনকভাবে পশ্চাৎ প্রসরণ করেছেন।

তখন দিল্লিতে মার্কিন অ্যাম্বাসেডর ছিলেন বিখ্যাত হার্ভার্ডের শিক্ষক জন ফেনেথ ভলবে। উনি বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ছিলেন। আমি উনার অনেক বই পড়েছি। এই ব্যক্তি ছিলেন জন এফ কেনেডির বন্ধু। তো ওই অ্যাম্বাসেডরের মাধ্যমে পণ্ডিত নেহেরু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জনএফ কেনেডির কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। যে বার্তায় বলা হয়েছিল, পাকিস্তানকে যেন আমেরিকা বলে যে, পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে যেন ভারতের সৈন্যদের চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়।

তো আইয়ুব খান তো আরেক কাঠি সরস। তিনি বললেন, আমরা তো আমেরিকার সামরিক জোটে আছি। সিটোর জোট। উনাদেরকে আসতে বলেন, আমরা সীমান্ত খুলে দেব। পণ্ডিত নেহেরু তো তখন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা। যে কারণে নেহেরু বা ভারতের সঙ্গে আমেরিকার তখন কোনো জোট হয়নি। এখনো নেই। পণ্ডিত নেহেরু কিন্তু তারপরে আর বেশি দিন বাঁচতে পারেনি।

তো, নেহেরুর কন্যা যখন সুযোগ পেলেন সেভেন সিস্টারের সঙ্গে সংযোগের জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করার। যখন ৭১ এ প্রবাসী সরকার গঠিত হল। তখন ইন্দিরা গান্ধী সেই সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাননি। তিনি প্রবাসী সরকারের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি করেন। এই চুক্তির কথা আমি হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর কাছ থেকে শুনেছি। হুমায়ুন রশিদ চৌধুরি তখন দিল্লিতে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধি। প্রবাসী সরকারকে ভারত তখনও স্বীকৃতিই দেয়নি। তারপরও তারা এই চুক্তিটা করে। চুক্তি হওয়ার পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব কিন্তু সেই চুক্তি বাতিল করেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সকল সৈন্যকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। এই কৃতিত্ব তাকে দিতেই হবে। এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন একটা ভিত্তিতে দাঁড় করাতে এই উদ্যোগটা ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল।

এই যে, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে একটা করিডোর পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ভারতের, সেটা কিন্তু অনেক দিনের। ১৯৬২ সাল থেকে ভারত চেয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে তাদের একটা করিডোর। এই কথাটি আমাদের বুঝতে হবে।

এখন হাসিনার সঙ্গে একই বিষয়ে ভারতের দ্বিতীয়বার যখন বোঝাপড়া হলো, তারা কিন্তু তাদের সব ডিম একটি ঝুঁড়িতেই রেখে দিল। এটার একটা কারণ, হলো ৬২ সালের ট্রমা থেকে ভারত বের হতে পারেনি। তো এই যে সাজানো জিনিসটি ভারতের টিকলো না এবং তাদের ক্ষতিই তো হল। ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের বন্ধু ভাবাপন্নতা ও আস্থা তো নষ্ট হয়ে গেল। এখন কথা হচ্ছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারত খুব বেশি আন্তরিক হবে না। তারা দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক পক্ষগুলোর জন্য অপেক্ষা করবে। অথবা তারা তাদের পলিসি হোল্ড করে রাখবে। এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতের জন্য ক্ষতিকর কোনো কিছু যেন না হয়, সে বিষয়ে তারা চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। শেখ হাসিনার সময় ভারত যে সব সুবিধা পেয়েছে, সেসব সুবিধা পেতে চেষ্টা করবে ভারত। তারা এ জন্য বাংলাদেশকে নানা ভাবে চাপ দেবে। আর এজন্য ভারতকে সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমের তো অভাব নেই। ১৫ বছর ধরেই তো দেখেছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন পক্ষকে ভারত ব্যবহার করেছে। গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদদের বাগে আনতে ভারত ইনভেস্ট করেছে।

তবে যত যাই হোক না কেন। ভারতকে সব সময় তাদের বড় স্বার্থের কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। সেটা হলো সেভেন সিস্টার। ভারতের এই সাতটি রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক। এই দিক দিয়ে ভারত কিন্তু বাংলাদেশের কাছে ঠেকা।

পিনাকী ভট্টাচার্য: ঠিক আছে। কিন্তু আমি আমার স্বার্থ দেখবো ঠিক আছে। কিন্তু আরেকটি রাষ্ট্র বা মানুষকে দমন-পীড়ন করে, নির্যাতন করে। এটা তো মেনে নেয়া যায় না।

খলিলুর রহমান: এই জিনিসটা হয়ত এখন ভারতের বোধগম্য হবে।

পিনাকী ভট্টাচার্য: এটা কীভাবে ভারতের বোধগম্য হবে? দেখুন, হাসিনা দিল্লিতে থাকা অবস্থায় ড. ইউনূস কিন্তু বলেছেন, হাসিনা ভারতে থাকুক। কিন্তু চুপ থাকুক। কিন্তু হাসিনা তো চুপ নেই। তার কল রেকর্ড ফাঁস হচ্ছে। সে বলছে, আমি সীমান্তের কাছাকাছি আছি। চট করে ঢুকে যেতে পারি। এখন কথা হচ্ছে। এত এত আওয়ামী লীগের নেতারা, তারা পালিয়ে যাচ্ছে। তারা কোথায় পালাচ্ছে? তারা সবাই ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। যারা ধরা পড়ছে, তারা ভারতের সীমান্তে ধরা পড়ছে। এখন ভারত কি এটা বুঝেছে যে তারা আগে যা করেছে সেটা ভুল? এটা যদি ভারত বুঝেই থাকে, তাহলে কেন তারা আওয়ামী লীগের নেতাদের আশ্রয় দিচ্ছে?

খলিলুর রহমান: আমি আপনাকে বলি। আপনি যদি এটা করে পার পেয়ে যান, তাহলে আপনি এটা করবেন। এখন বলি, ভারতের কেউ যদি এখন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়, ভারত কি সেটা সহ্য করবে? কখনোই করবে না। আমরাও কিন্তু ভারতীয়দের ফেরত দিয়ে দেবো।

এখন কথা হচ্ছে, ভারতে যে হাসিনা আশ্রয় নিল, সে তো এসাইলামে নেই। তার ভিসা পাসপোর্টও নেই। তাহলে সে কীভাবে ভারতে থাকছে? তবে ভারত সামনের দিনে হয়ত বাংলাদেশের সম্ভাব্য ক্ষমতায় যারা আসতে পারে, তাদের সাথে কাজ করবে। অথবা তারা এমন কারো সঙ্গে কাজ করতে চাইবে, যারা সামনে ক্ষমতায় আসার জন্য যোগ্য। এমনকি তারা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীদেরও পুনর্বাসনের কাজ করতে পারে। যদিও আওয়ামীদের পুনর্বাসন করা এত সহজ হবে না। এটা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। বাংলাদেশের মানুষ আর আগের ব্যবস্থা মেনে নেবে না।

সেটা ভারতকেই বুঝতে হবে। ভারত চাইলেও আর কখনোই হাসিনার মতো কাউকে দিয়ে, হাসিনা স্টাইলে বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।

এখন আমাদের কাজ কী?

ফ্যাসিবাদের যে জঞ্জাল সৃষ্টি হয়েছিল। সেই জঞ্জাল ধ্বংস হবে। সেই ধ্বংস স্তুপের ওপর নতুন একটি অটোনমাস ফরেন পলিসি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমি অটোনমাস বলছি, ইনডিপেনডেন্ট বলছি না। কারণ, বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশই স্বাধীনভাবে নিজেদের পলিসি করতে পারে না। একটি দেশের সঙ্গে অপর দেশের সম্পর্ক ও কৌশলগত পলিসি তৈরি হয়। হাসিনা আমলের বাংলাদেশের পলিসি থেকে বেরিয়ে একেবারে নতুন একটি পলিসি তৈরি করা এখন সবচেয়ে জরুরি। হাসিনা আমলে বাংলাদেশে কোনো ফরেন পলিসি ছিল না। কাজেই, নতুন একটি ফরেন পলিসি ছাড়া বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে না। এই পলিসি এমন হবে, যেন বাংলাদেশের স্বার্থ সবার আগে প্রাধান্য পায়। বাংলাদেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখবে।

এখন ভারত যেভাবে চাপ দেবে, সেটা যদি সঠিক ভাবে মোকাবিলা করা না যায়, তাহলে ফ্যাসিবাদের দোসর শক্তির পুনর্বাসন সহজ হবে। ভারতের চাপ সামলাতে না পারলে আপনি ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন ঠেকাতে পারবেন না। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এই যে এত মানুষ শহিদ হলো, রক্ত দিল, আহত হল। তারপরও কেন ভারতের চাপে আবারও ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসিত হবে।

পিনাকী ভট্টাচার্য: ভারত যে এখন চাপ দিতে শুরু করেছে, এমন একটি উদাহরণ দেবেন?

খলিলুর রহমান: আমি এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, ভারতের চাপ সফলভাবে সামলাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা। ড. ইউনূস বলেছেন, ভারত যে বলছে বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থান হচ্ছে, মৌলবাদে উত্থান হচ্ছে। ভারতের এসব কথা ইউনূস পাত্তাই দেননি। ইউনূস বলেছেন, ভারতের এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন, কোনো সত্যতা নেই। এমনকি হাসিনা প্রসঙ্গেও ড. ইউনূস ভারতকে কঠোর বার্তা দিয়েছেন।

পিনাকী ভট্টাচার্য: রাহুল গান্ধী আমেরিকাতে বলেছেন, বাংলাদেশে উগ্রবাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এটার আবার শক্ত ফিডব্যাক দিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, রাহুল গান্ধীর বক্তব্য মোটেই সত্য নয়। যদিও এই কথাটি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও শক্তি ভাবে বলতে পারতেন। সেটি হওয়াই উচিত ছিল।

আমি একটা কথা বলি সবসময়। ভারতের সঙ্গে কুত্তার মতো ব্যবহার করতে হবে। ঘেউ ঘেউ করে উঠতে হবে। ভারতের সঙ্গে কোনো ভদ্রতা দেখানো উচিত হবে না। ভারতকে উগ্র ভাবে প্রতিউত্তর না করলে ওরা ভয় পাবে না। ভারতে তোয়াজ করার কোনো মানে নেই। ভারত আমাদের প্রকাশ্য শত্রু। এ দেশের মানুষের শত্রু। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শত্রু। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন আর মন্ত্রী বলেন, জয়শঙ্করের মতো হতে হবে তাকে। খেউ খেউ করে উঠতে হবে। ভালো কথাটিও খেও খেও করে বলে উঠতে হবে। ভারতের সঙ্গে ভদ্রতা দেখানোর কিছু নেই। এটা ছাড়া ভারতকে ঠেকানো যাবে না।

খলিলুর রহমান: ভাই, আমেরিকাকে দেখুন। অর্থনীতি, সামরিক শক্তি বা অন্য যেকোনো মানদণ্ডে আমেরিকা কিন্তু সবার উপরে। তারা কিন্তু কখনোই শক্ত ভাষায় খুব একটা কথা বলে না। প্রয়োজন হলে বলে। গত ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদী শক্তি যেভাবে কথা বলেছে, সেটা শুনে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমরা ফ্যাসিবাদী হাসিনার কথা শুনে ভয় পেতাম। এজন্যই আমরা এখনো ওইরকম শক্ত কথা শুনতে বা বলতে চাচ্ছি।

পিনাকী ভট্টাচার্য: ‘র’ মানেই জেমস বন্ড। র মানে কত কিছু। কিন্তু কি হলো এটা।

খলিলুর রহমান: তারা যতটা শক্তিশালী, তার চেয়ে প্রচারণা বেশি। আদতে যতটা ছড়িয়েছে, তারা ততটা নয়। কারণ, তারা আমাদের ছাত্রদের সামনেই টিকতে পারেনি। ছাত্রদেরই ম্যানেজ করতে পারেনি। তাদের দুর্বলতা ব্লাস্ট হয়ে গেছে। এখন কথা হচ্ছে, ভারতের অব্যাহত চাপ শক্তভাবে মোকাবিলা করা আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, আমাদের কৌশলগত পলিসি রিফর্ম করা। আমি এটা নিয়ে পরে আলোচনা করব। ভারতের এই নীতি বিপর্যয়ের কারণে তাদের কৌশল ব্যর্থ হয়ে গেছে।

এখন ভারতের এই বিপর্যয়ের সুযোগে অন্যান্য বিদেশি শক্তিগুলো বাংলাদেশ থেকে সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবে। বাংলাদেশের পাশে এখন যারা দাঁড়িয়েছে, তারা কি তাদের স্বার্থে বাংলাদেশে বড়শি ফেলবে? এসব কিছুই মনোযোগের সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে। সতর্কতার সঙ্গে। বাংলাদেশ যেন জ্বলন্ত আগুন থেকে বেরিয়ে ফুটন্ত কড়াইতে গিয়ে না পড়ে। এখন আগামীতে যদি বাংলাদেশের সামনে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ আসে, সেটা আমাদের সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। কোনো একক পরাশক্তি বা উদীয়মান শক্তির কাছে যেন আমরা বন্দি হয়ে না পড়ি তার জন্য আমাদের নতুন ফরেন পলিসি অত্যন্ত জরুরি।

এরই মধ্যে বিশ্বেও বিভিন্ন শক্তিধর দেশ বাংলাদেশে আসছে। তাদের প্রতিনিধিরা আসছে। তারা বাংলাদেশকে নিজেদের ডেরাই রাখতে চাইছে। কেউ কেউ তাদের সুর বদলাচ্ছে। এমনকি দেশের ভেতরেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের সুর বদলাচ্ছে। রাজনৈতিক পক্ষগুলো নানা ভাবে কথা বলছে। এসব কিছু যদি যদি আমরা সফল ভাবে সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে না পারি, তাহলে সমস্যা সৃষ্টি হবে। বিভিন্ন অ্যালায়েন্স তৈরি হচ্ছে, হয়েছে, হবে। এসব অ্যালায়েন্সের দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। আমরা যেন কারও সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে গিয়ে কোনো দেশের কাছে শত্রু হিসেবে পরিণত না হই। যে সব দেশ আমাদের ফ্যাসিবাদ হটাতে ও গণতন্ত্র ফেরাতে আমাদের জনগণকে সমর্থন দিয়েছে, সেসব বন্ধুদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। তবে এই টানাটানির শেষ কোথায় গিয়ে হবে তা আমার জানা নেই। এটা কিন্তু ঝুঁকিরও বটে। ভারতের এই সব কর্মকাণ্ড যদি সরকার শক্তভাবে প্রতিবাদ না করে, পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে সেটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর হবে।

পিনাকী ভট্টাচার্য: সরকার এটা তো দেখবেই। তাদের দেখা উচিত। কিন্তু আমাদের পাওয়ারের যে উৎস, আসল যে স্টেকহোল্ডার রাজনৈতিক দলগুলো তারা তো এটা মানবে না। আমাদের প্রধানতম দুই স্টেক হোল্ডার রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াত। এখন কথা হচ্ছে যে, গ্লোবাল পাওয়ার যে দেশগুলো বা প্রতিষ্ঠানগুলো, তাদের সঙ্গে ডিল করার সক্ষমতা কি এই রাজনৈতিক দলগুলোর আছে?

খলিলুর রহমান: ডিল করা তো অনেক পরের কথা। জিনিসগুলি যা ঘটছে, তা বুঝার সক্ষমতা আছে কিনা সেটাও তো প্রশ্ন। এখন কথা হচ্ছে, দু বছর হোক তিন বছর হোক, দেশে নির্বাচন তো হবে। যদি দেশে এর ভেতরে অন্য কিছু ঘটে না যায়। এবং দেশে যে অন্যকিছু ঘটে যাবে না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এটা কেউ বলতে পারে না।

এখন নির্বাচনের পরে যে দলটি ক্ষমতায় আসবে, তারা কি হাসিনা-ভারতের যে বন্দোবস্ত ছিল, সেটা আর দেশে হবে না, এটা তারা নিশ্চিত করতে পারবে? এই যে দেখুন, নাৎসিরা ইহুদিদের কত বড় ক্ষতি করেছে, সেই ক্ষতি কিন্তু ইহুদিরা আর ঘটতে দেয়নি। তারা ছোট্ট একটা জাতি। কিন্তু তারা সেটা পেরেছে। আমরা তো অনেক মানুষ। আমাদের জাতি কেন পারবে না।

পিনাকী ভট্টাচার্য: বাধ্যতামূলক সামরিক ট্রেনিং নিয়ে আপনি যেটা বললেন, আমিও এটা নিয়ে কথা বলেছি বহুবার। আমাদের মিলিটারি সক্ষমতা প্রয়োজন। লং রেঞ্জ মিসাইল দরকার। সামরিক ট্রেনিং নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারটি অনেকেই প্রমোট করছে। আমাদের এমন পাল্লার মিসাইল লাগবে, যেটা দিল্লিতে আঘাত হানতে সক্ষম হবে। ডেফিনেটলি, আমার ওপর আক্রমণ করলে আমি যেন ওখানে মারতে পারি। সেই ব্যবস্থা আমাদের থাকতে হবে।

খলিলুর রহমান: আমি যে কথা টা বলব, আমাদের এমন পর্যায়ে করা উচিত, যে কেউ আমাদের ওপর আঘাত করার আগে ভাবে, যে আমরা কেমন প্রতিরোধ করতে পারি। আমরা আঞ্চলিক সামরিক জোট প্রয়োজন নাই। ইন্দো প্যাসিফিক জোটেও আমাদের যাওয়া দরকার নেই। আমাদের বিপ্লবী জনতা রয়েছে। আমরা আমাদের জনগণ নিয়েই সব বাধা অতিক্রম করব। এই জনগণই আমাদের আসল শক্তি।

আমি মনে করি, পশ্চিমা ও চীনের সঙ্গে আমাদের সমান সম্পর্ক দরকার। আমাদের এই সম্পর্কেও একটা প্যাটার্ন রয়েছে। আমরা কাউকে শত্রু ভাবতে চাই না। ভারতকেও শত্রু ভাবতে চাইনা। কিন্তু কেউ যদি আমাকে দুরে ঠেলে দেয়, তাহলে তো আমরা বসে বসে বন্ধুত্ব করতে পারি না। আমাদের কোনো জোটে যাওয়ার দরকার নেই। বরং জোট আমাদের কাছে আসবে।

আমাদের ফরেন পলিসি কেমন হবে

খলিলুর রহমান: আমাদের অটোনমাস ফরেন পলিসি তৈরি করতে হবে। আমাদের স্বার্থেও মাপকাঠিতে আমাদের ফরেন পলিসি হতে হবে। যে আমাদের স্বার্থ দেখবে না, তার সঙ্গে আমাদের কোনো ফরেন পলিসি থাকবে না। আমাদের রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাতেই দিতে হবে। জনগণের সাথে সম্পৃক্ত করে রাষ্ট্রীয় অফিসগুলো চালানো প্রয়োজন। পলিসি মেকিং সহজ হবে তাহলে।

পাচারকৃত টাকা ফেরত আনা যাবে কি?

হ্যাঁ, পাচারকৃত টাকা ও সম্পদ বিদেশ থেকে ফেরত আনা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকার বিশেষ টাস্কফোর্স বা কমিশন করতে পারে। জাতিসংঘ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আইএমএফের মাধ্যমে পাচারকৃত টাকা উদ্ধারের ব্যবস্থা করা যাবে। সামিট গ্রুপের মতো লুটেরাদের সম্পদ ফেরানোর উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে।

সর্বোপরি, বলতে চাই, এই আন্দোলনে অনেক মেধাবীরা ছিল। মেধাবীদের হাতেই এই অসম্ভব সফলতা সম্ভব হয়েছে। কাজেই, তাদের এই কৃতিত্ব দিতেই হবে। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বেও পরিবর্তন দরকার। বিএনপি বা অন্য দলগুলোর মধ্যেও গুণগত পরিবর্তন করতে হবে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ডায়নামিক হতে হবে। দলগুলোর উচিত হবে, মানুষের পালস বুঝা। মানুষের চাওয়া পাওয়ার প্রাধান্য দিতে হবে।

২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:১০পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।