• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এক নজরে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীর আফগানিস্তান যুদ্ধ

এক নজরে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীর আফগানিস্তান যুদ্ধ

ফাইল ছবি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

আফগানিস্তানের দখল আবারও তালেবানের হাতে ফিরতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে তারা দেশটির ৭০ শতাংশেরও বেশি অঞ্চল দখলে নিয়েছে। আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, স্থলবন্দর ও সীমান্ত চৌকিগুলো এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে। দেশটির সরকারি বাহিনীর শত শত সেনা তালেবানের কাছে আত্মসমর্পন করছে। দীর্ঘ ২০ বছরের মার্কিন-ন্যাটো জোটের হামলা ও অভিযানের পরও তালেবানের এমন শক্ত প্রত্যাবর্তন মধ্য এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

তালেবান এত শক্তি কোথায় পাচ্ছে? নাকি তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তলে তলে হাত মিলিয়েই সব কাজ করছে, সেটা নিয়েও চলছে গুঞ্জন। তবে আপাত দৃষ্টিতে এটাই আমরা বলতে পারি, মার্কিন বাহিনী আফগান ছেড়েছে, তালেবান আফগানে আবার ফিরেছে। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর তালেবান তাহলে কোথায় ছিল? কিভাবে তারা টিকে থাকলো? এসবই এখন কমন প্রশ্ন।

তালেবানের জন্ম গৃহযুদ্ধ থেকে। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আর্মি আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারের সমর্থনে দেশটিতে আগ্রাসন চালায়। তখন সোভিয়েতের নাক গলানোকে সেসময় আফগানরা মেনে নিতে না পেরে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পরে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। দীর্ঘ লাশের সারি পেরিয়ে ১৯৮৯ সালের ৩০ জানুয়ারি আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বিদায় হয়।

সোভিয়েতের এই বিদায়ের পেছনে বড় অবদান তালেবানের। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত (রাশিয়া) বিতাড়িত করে। মূলত সৌদি আরবের কূটনৈতিক তৎপরতায় যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের সঙ্গে মিলিত হয়। এছাড়া সৌদি আরব গৃহযুদ্ধ চলাকালীন আফগানিস্তানে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার প্রসারে অর্থায়ন শুরু করে। এই অর্থায়নের আঞ্চলিক দায়িত্ব ছিল আফগানিস্তানের তালেবানের ওপর। আর এই সুযোগটিই কাজে লাগিয়ে তালেবান তার দেশের গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্থ জাতিকে পুনর্বাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেয়। তালেবানের প্রতিশ্রুতিতে আফগানিস্তানের মানুষের মন গলে। তারা তালেবানকে ক্ষমতায় আসীন করে।

৯/১১ হামলা ও ওসামা বিন লাদেন: ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ইতিহাসের একটি কালো দিন। এ দিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে জোড়া বিমান হামলা চালানো হয়। সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত তিন হাজার মানুষ নিহত হন। এঘটনা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দেয়। হামলার দায় গিয়ে পড়ে জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদার ওপর। ওই ঘটনার পর আল কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেন হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়। পরিস্থিতি রাতারাতি পাল্টে যেতে থাকে। বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করার স্বার্থে ও সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে ওই বছরই আফগানিস্তানে হামলা শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

এই হামলার পেছনে অন্যতম কারণ হলো, ওসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তানের তালেবান আশ্রয় দিয়েছিল। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে আফগানিস্তান। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ সরাসরি আফগানিস্তানে হামলার ঘোষণা দেন।

জর্জ ডবিøউ বুশ ও আফগানে মার্কিন আগ্রাসন: জর্জ ডব্লিউ বুশের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আফগানিস্তানে তালেবান সতর্ক অবস্থানে চলে যায়। কিন্তু ন্যাটো জোট ও মার্কিন বাহিনীর যৌথ হামলায় তালেবান কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সশস্ত্র তালেবান দুই মাস মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গা ঢাকা দেয়। তালেবানের অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ ও লাখ লাখ কর্মী সমর্থক প্রতিবেশী পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। এমনকি তালেবানকে সেসময় পাকিস্তান ও ইরান অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছে বলেও জানা গেছে। কিন্তু পাকিস্তান ও ইরান বরাবরই তা অস্বীকার করেছে।

ন্যাটো-আফগান বাহিনীর দুর্বলতা: ন্যাটো জোট ও মার্কিন বাহিনীর হামলায় বিপর্যস্থ আফগান তালেবান পাকিস্তানে বসেই শক্তি বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করে। তারা বহিঃবিশ্ব থেকে অর্থ সংগ্রহের কাজ তলে তলে ঠিকই চালিয়ে গেছে। এছাড়া পাকিস্তানে বসে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছে তালেবান যোদ্ধারা। যা এখন পানির মতো পরিষ্কার।

এর পর ২০১৪ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোজোট আফগানিস্তানের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেশটির সরকারী বাহিনীর ওপর ন্যস্ত করে। ন্যাটোজোট ও মার্কিন সেনারা আফগানিস্তানে থাকলেও তারা দেশটিতে বিশেষ অভিযান ছাড়া অন্য কোনও সামরিক অভিযানে অংশ নেয়নি। আফগানিস্তানের নিরাপত্তার যাবতীয় দায়িত্ব যখনই দেশটির সরকারী বাহিনীর হাতে এলো, তখন থেকেই ধীরে ধীরে তালেবান তাদের খোলশ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করে।

তালেবানের চোরাগুপ্তা হামলায় দেশটির সরকারী বাহিনীর হাজার হাজার সেনা নিহত হয়েছেন। গত ১০ বছরে অসংখ্য সরকারী স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে তালেবান। এসব হামলা রুখে দেয়া তো দূরের কথা, তালেবানের সামনে দাঁড়াতেও পারেনি আফগান সরকারী বাহিনীর সেনারা।

আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় সেনাঘাঁটি বাগরাম ঘাঁটি থেকে দু-সপ্তাহ আগে মার্কিন সেনা ও ন্যাটোভুক্ত সেনাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর আগে প্রায় ১০ হাজার সেনা বাগরাম ঘাঁটিতে অবস্থান করছিল। কিন্তু তারা আফগান সরকারের বাহিনীর সঙ্গে কোনও সামরিক অভিযানে আগের মতো আর অংশ নেয়নি। এতে করে আফগানিস্তানে তালেবান নির্বিঘ্নে হামলা চালিয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় ও ন্যাটো জোটের সেনা সংখ্যা: 

মার্কিন সরকারের একটি হিসাব বলছে, ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে আফগানিস্তানে তালেবান ঠেকাতে এক লাখ মার্কিন সেনা মাঠে নিয়োজিত ছিল। যে কারণে ওই দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের ব্যয় বেড়ে গিয়েছিল ১০০ বিলিয়ন ডলার। পরে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের মাঠ থেকে নিজেদের সেনা তুলে নেয়। তারা মনোযোগ দেয় আফগানিস্তান সরকারী বাহিনী পুনগর্ঠনে। মার্কিন সেনারা আফগান সরকারী বাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য ইনডোর ট্রেনিং শুরু করে।

এতে ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক যুদ্ধ ব্যয় নেমে দাঁড়ায় ৪০ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক হিসাব বলছে, ওই দুই বছরে গড়ে ব্যয় হয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলার।

ন্যাটো: ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আফগানিস্তানে রিসলিউট সাপোর্ট মিশনের (আরএসএম) আওতায় প্রায় ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করে ন্যাটো। ৩৬টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত সামরিক জোট ন্যাটো আফগানিস্তানের ৫টি অঞ্চলে তাদের সেনা মোতায়েন করে। এর মধ্যে কান্দাহার ও লাঘান তাসি অঞ্চলের দায়িত্ব পায় মার্কিন বাহিনী। এছাড়া জার্মানি, তুরস্ক ও ফ্রান্স আফগানিস্তানে তাদের সেনা মোতায়েন করে।

তালেবানের পুনরুত্থান: দীর্ঘ ২০ বছর পর আফগানিস্তান ছেড়েছে মার্কিন বাহিনী ও ন্যাটো। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সই করা চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের আগেই মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়তে চেয়েছিল। কিন্তু তালেবানের সাম্প্রতিক শক্তি প্রদর্শন ও আগ্রাসী আচরণে অনেকটা ভীত হয়েই মার্কিন বাহিনী ও ন্যাটো আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে। এতে করে সবচেয়ে বিপদে মুখে পড়েছে দেশটির সরকার।

গত কয়েক সপ্তাহে তালেবান দেশটির ৭০ শতাংশ এলাকা দখল করে নিয়েছে। দখলকৃত এলাকা থেকে কর আদায় ও ব্যবসা বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণও নিয়েছে তালেবান। এসব এলাকার খনিজ সম্পদ ও জাতীয় স্থাপনা এখন তালেবানের জিম্মায়। একমাত্র কাবুল ছাড়া আফগানিস্তানের কোনও শহরই এখন আর আফগান সরকারের অধীনে নেই। তালেবান একের পর এক হামলা চালিয়ে দখল করে নিয়েছে। তালেবানের হামলায় অনেকেই নিহত হয়েছে।

তালেবানের টিকে থাকার নেপথ্যে: মার্কিন বাহিনী ও ন্যাটো জোটের দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চালানো সম্মিলিত হামলা ও অভিযানের পরও তালেবান আফগানিস্তানে টিকে আছে। বিষয়টি আশ্চর্যজনক বটে। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, তালেবান গত ২০ বছরে পাকিস্তানে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে। পাকিস্তানে তারা খাবারও পেয়েছে। এছাড়া এই সংগঠনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তহবিল সংগ্রহ করেছে। আফগানিস্তানে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো থেকে তালেবান ঝটিকা হামলা ও অভিযান চালিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।

তবে তালেবানের আয়ের অন্যতম উৎস মাদক ব্যবসা। বিশ্রেব সবচেয়ে দামি মাদক আফিমের চাষ আফগানিস্তানে বেশি হয়। আর আফিম চাষের এলাকাগুলো সবই তালেবানের দখলেই ছিল। সাধারণ আফগানদের সঙ্গে তালেবান মিশে গিয়ে আফিমের ব্যবসা করেছে। উপার্জিত অর্থ তারা তাদের পুনর্গঠনে ব্যয় করেছে।

আগামীর আফগান: আগামীর আফগানিস্তান কেমন হবে তা এখনই বলা কঠিন। গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ ও আফগানিস্তান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে অন্তত এটা বুঝা যাচ্ছে যে, আফগানের কর্তৃত্ব আবারও হয়তো তালেবানের হাতেই ফিরতে যাচ্ছে। কারণ ধর্মীয় শাসন কায়েম করতে চাওয়া তালেবান এখন অতিতের পথে হাটছে না। তারা দেশ পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। আফগানিস্তানের জনগণের সঙ্গে মিলে মিশে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার ঘোষণা দিয়েছে তালেবান। এসব ঘোষণায় আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ তালেবানকে কতটা গ্রহণ করবে তা সময়ই বলে দিবে।

তবে সবশেষে এটা অনেকটাই স্পষ্ট যে, ২০০১ থেকে ২০২১ এর আজকের দিন পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী, ন্যাটো ও আফগান সরকার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে, তালেবানের উত্থান ঠেকাতে আফগান সরকার যে নীতি গ্রহণ করেছে, তার সবই ব্যর্থ হয়েছে। তালেবান ভরাডুবি থেকে যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। কিন্তু তালেবানের এই নতুন আগমনে আফগানিস্তান ও সংলগ্ন অঞ্চলে যে অশান্তি ও প্রাণহানীর নতুন ঢেউ বইতে শুরু করেছে, তা আতঙ্কের ও আশঙ্কার বটে।

 

এবি/এসএন

 

২১ জুলাই ২০২১, ০৪:৫৫পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।