• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ই-বর্জ্য : বৈশ্বিক পরিবেশের জন্য নতুন এক আতঙ্ক

ই-বর্জ্য : বৈশ্বিক পরিবেশের জন্য নতুন এক আতঙ্ক

প্রতিকী ছবি

ফিচার ডেস্ক

তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক বিজ্ঞানের বর্তমান বিশ্বে মানুষের হাতের মুঠোয় গোটা পৃথিবী। দৈনন্দিন কাজকর্ম, অফিস-আদালত, বাসা-বাড়ি, গাড়ি কিংবা বিনোদন, সব ক্ষেত্রেই মানুষ এখন প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। হাতে হাতে উঠেছে স্মার্টফোন। অফিসের কাজ চলছে ল্যাপটপ কিংবা কম্পিউটারে। করোনাকালীন ভার্চুয়ালি ক্লাস-পরীক্ষা চালু করায় দেশের শিক্ষার্থীদের হাতেও এখন স্মার্টফোন। শিক্ষা, চিকিৎসা, ক্রীড়া, বিনোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা চাকরি, সবকিছুই এখন তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক ডিভাইসের ওপর নির্ভরশীল।

এসব ডিভাইস আমাদের জীবনযাত্রা সহজ করেছে ঠিক। কিন্তু ক্রমবর্ধমান এই ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো একটা সময় নষ্ট বা বিকল হয়ে যায়। এসব যন্ত্রাংশ বা ডিভাইস নানা ধরণের ধাতু, রাসায়নিক পদার্থ, প্লাস্টিক, রাবার ও রূপান্তরিত ধাতু দিয়ে তৈরি। ফলে এসব জিনিস যখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকছে, তখন তা বর্জ্য হিসেবে পড়ে থাকছে। এগুলো মানবদেহ ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রিয় পাঠক, এই পর্বে আমরা ই-বর্জ্য নিয়ে কিছু তথ্য দেয়ার চেষ্টা করেছি। ই-বর্জ্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকা প্রয়োজন। চলুন দেখে নেয়া যাক ই-বর্জ্য কী?

ই-বর্জ্য কী

জেনেভা এনভায়োরনমেন্ট প্রটোকলে বলা হয়েছে, অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বাসাবাড়িতে ব্যবহারের পর যেসব ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য অচল হয়ে যায়, এগুলোই মূলত ই-বর্জ্য। ব্যবহার অনুপযোগী ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোই সহজ ভাষায় ‘ই-বর্জ্য’ নামে পরিচিত। ইংরেজিতে এগুলোকে বলা হয় Wast Electrical and Electronic Equipment। সংক্ষেপে যা WEEE এবং বাংলায় ই-বর্জ্য হিসেবে পরিচিত।

কিভাবে সৃষ্টি হচ্ছে ই-বর্জ্য

পরিবেশবিদ ও পরিবেশ আন্দোলনের বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিত্যক্ত ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো যত্রতত্র নিক্ষেপ এবং নিয়মকানুনহীন সংগ্রহ ও পুনঃচক্রায়ন কৌশলের কারণে দিন দিন তা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে। এ ছাড়া যেখানে সেখানে এসব পরিত্যক্ত ডিভাইস ফেলে রাখার কারণে পরিবেশেও বিরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

তবে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে বর্তমানে একেক দেশে একেক ভাবে ই-বর্জ্যকে নির্দেশ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্সকে (টিভি, কম্পিউটার প্রভৃতি) আর ইউরোপে ব্যাটারি বা পাওয়ার কর্ড সম্বলিত সব ইলেকট্রিক দ্রব্যকে ই-বর্জ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

ই-বর্জ্য যত রকম

উপাদান এবং গাঠনিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ই-বর্জ্য দুই ধরনের। লৌহজাত এবং লৌহ বহির্ভূত। লৌহ বহির্ভূত ই-বর্জ্যরে মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিক, তামা, গ্লাস, ফাইবার, কার্বন ইত্যাদি। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ই-বর্জ্যকে দশটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে। ইউরোপের ই-বর্জ্যের উৎস ভিত্তিক এই বিন্যাস বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

→ বড় ধরনের গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি। যেমন- রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, ওয়াশিং মেশিন, ক্লথ ড্রায়ার, ডিশ ওয়াশার, রান্নার বৈদ্যুতিক চুলা, হট প্লেট, মাইক্রোওয়েভ, ইলেকট্রিক ফ্যান, এয়ার কন্ডিশনার।

→ ছোট ধরনের গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি। যেমন- ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, টোস্টার, গ্রাইন্ডার, কফি মেকার, ইলেকট্রিক শেভার, ট্রিমার, হেয়ার ড্রায়ার, রাইস কুকার, ওয়াটার হিটার, কারি কুকার।

→ তথ্যপ্রযুক্তি এবং যোগাযোগ বিষয়ক যন্ত্র। যেমন- মেইনফ্রেম কম্পিউটার ও মিনি কম্পিউটার, ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, পাম্পটপ, ট্যাব, নোটবুক, প্রিন্টার, টোনার, ফটোকপিয়ার, টেলিফোন ও সেলফোন, পেনড্রাইভ, স্ক্যানার, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট, ব্রডব্যান্ড ও ওয়াইফাই যন্ত্রাদি।

→ ভোগ্যপণ্য যন্ত্রাদি। যেমন- রেডিও, টেলিভিশন, ভিডিও ক্যামেরা, ভিডিও রেকর্ডার, ডিভিডি প্লেয়ার, স্টেরিও রেকর্ডার, ডিজিটাল ক্যামেরা, ডিএসএলআর, এমপ্লিফায়ার এবং হেডফোনসহ গান শোনার নানান যন্ত্রাদি।

→ আলোকিতকরণ সামগ্রী। যেমন- ফ্লুরোসেন্ট বাল্ব, এনার্জি সেভিং বাল্ব, উচ্চমাত্রার ডিসচার্জ ল্যাম্প।

→ ইলেকট্রিক এবং ইলেকট্রনিক টুল। যেমন- ড্রিল মেশিন, কাঠ চেরাই মেশিন, সোল্ডারিং আয়রন, খননযন্ত্র, কাঠ ও অন্যান্য ধাতব দ্রব্যাদি প্রস্তুতির টার্নিং, মিলিং, গ্রাইন্ডিং, ফোল্ডিং ও বেন্ডিং মেশিন।

→ খেলনা, বিনোদন ও খেলাধুলার সামগ্রী। যেমন- ইলেকট্রিক ট্রেন ও রেসিং কার সেট, ভিডিও গেম, খেলাধুলা ও ব্যায়ামের যন্ত্রাদি।

→ চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সামগ্রী। যেমন- রেডিওথেরাপি মেশিন, এক্সরে, সিটি স্ক্যান, ম্যামোগ্রাফি মেশিন, ডায়ালাইসিস, ভেন্টিলেটর, নিউক্লিয়ার মেডিসিন মেশিন প্রভৃতি।

→ পরিবীক্ষণ ও নিয়ন্ত্রক যন্ত্রাদি। যেমন- স্মোক ডিটেক্টর, হেয়ারিং রেগুলেটর, থার্মোস্ট্যাট, ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা প্রভৃতি।

→ অটোমেটিক ডিসপেন্সার। যেমন- গরম পানিয়ের মেশিন (চা, কফি), গরম বা ঠাণ্ডা পানির ডিসপেন্সার, ওয়াটার পিউরিফায়ার, টাকা গণন যন্ত্র, সব ধরনের স্বয়ংক্রিয় ডিসপেন্সার প্রভৃতি।

ই-বর্জ্যরে ঝুঁকি

প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বের এই নতুন বিপ্লবে আমাদের জীবনযাত্রা সহজ ও স্বচ্ছন্দময় হয়েছে। কর্মক্ষমতা ও কর্মদক্ষতায় যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। কমেছে কাজের শারীরিক চাপ। বেড়েছে সময়। তবে একটা সময় কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সব ডিভাইসই নষ্ট হয়। আমরা সেই যন্ত্রগুলো পরিবর্তন করছি নিয়মিত। এই পরিত্যক্ত ডিভাইসগুলো আমরা ফেলে দিচ্ছি দেদার। এই ফেলে দেয়া যন্ত্রাংশগুলোই পরিবেশ ও প্রাণীদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। ফেলে দেয়া যন্ত্রাংশ ভাঙ্গারীর দোকান থেকে ভাগাড় ঘুরে পুনঃচক্রায়নের জন্য পরিশোধনাগারে স্থান পায়। এই পুরো প্রক্রিয়ায় বর্জ্য গুলো উন্মুক্ত আকাশের নিচে পড়ে থেকে রোদ, জলে, ভূগর্ভে যেমন দূষণ ছড়ায় তেমনি এগুলো সংগ্রহ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত মানুষের মধ্যেও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

এসব কারণে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক বর্জ্য অতি দ্রুত দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির উদ্যোগে আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে ই-বর্জ্য কে 'New and emerging environmental threats to human health' হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

কনফারেন্সে বলা হয়েছে, আধুনিক ইলেকট্রনিক পণ্যে ৬০ টির মতো বিভিন্ন ধরনের উপাদান থাকে। এর মধ্যে কিছু উপাদান মূল্যবান, কিছু ঝুঁকিপূর্ণ, আর কিছু উপাদান উভয়ই। ই-বর্জ্যে থাকা উপাদান গুলোর মধ্যে রয়েছে সিসা, ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম, তামা, অ্যালুমিনিয়াম, সোনা, রূপা, প্যালাডিয়াম, প্লাটিনাম, নিকেল, টিন, লেড (দস্তা), লোহা, সালফার, ফসফরাস, আর্সেনিক, পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি), পলিক্লোরিনেটেড বাই ফিনাইল(পিসিবি) ইত্যাদি।

যেভাবে ক্ষতি করে ই-বর্জ্য

মানবদেহের ক্ষতি: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক হাজারেরও বেশি বিষাক্ত পদার্থ থাকে পরিত্যক্ত ই-ডিভাইসগুলোতে। এসব নিত্যব্যবহার্য ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। টেলিভিশন ও কম্পিউটার মনিটরে থাকা সিসা, পারদ, কপার এবং মাদারবোর্ডে থাকা বেরিলিয়াম, সেলফোন, রেফ্রিজারেটর ও এসি'তে ব্যবহৃত ক্ষতিকর পদার্থ সমূহ ক্যান্সার ও কিডনি নষ্ট হওয়াসহ থাইরয়েড হরমোন বিপর্যস্ত করার মতো মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে।

পরিবেশের ক্ষতি: এসব ই-বর্জ্য ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির উৎসে দূষণ সৃষ্টি করে। দূষণ সুপেয় পানির প্রাপ্যতাকে কঠিন করে তোলে। এই উপাদানগুলোর প্রভাবে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বংশ বিস্তার বাধাপ্রাপ্ত হয়। বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য শৃংখল ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং সার্বিকভাবে পরিবেশ পরিবর্তনে এগুলো ভূমিকা রাখে।

একটি মোবাইল ফোনে প্রায় চল্লিশটি উপাদান থাকতে পারে। এরমধ্যে ২৩ শতাংশ ধাতব পদার্থ বাকি ৭৭ শতাংশ প্লাস্টিক ও সিরামিক। একটি হ্যান্ডসেটে ২৫০ মিলিগ্রাম সিলভার, ২৪ মিলিগ্রাম স্বর্ণ, ৯ মিলিগ্রাম প্যালাডিয়াম এবং ৯ গ্রাম তামা থাকে।

এছাড়া প্রতিটি মোবাইল ফোনের লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিতে গড়ে ৩.৫ গ্রাম কোবাল্ট থাকে। এগুলো ছাড়াও সিসা, জিংক ও আর্সেনিকের মতো ক্ষতিকর উপাদান থাকে। তাই ব্যাটারিসহ ফোনসেট উন্মুক্ত ভূমিতে ফেললে তা মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত ক্যাডমিয়াম ছয়হাজার লিটার পর্যন্ত পানি দূষণ করতে পারে।

যে উপাদানে যে ক্ষতি

নিকেল: অনেক ডিভাইসে নিকেলের প্রলেপ থাকে। এই উপাদান থেকে ফুসফুস, নাক, প্রোস্টেট প্রভৃতি অঙ্গে ক্যান্সার হতে পারে। হৃদপিন্ডের অনিয়মিত গতির জন্যও নিকেল দায়ী।

সিসা: প্রাণীকূল ও পরিবেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর পর্দাথ এটি। সিসা কোনো ভাবে মানবদেহে প্রবেশ করলে মস্তিষ্ক ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্থ হয় উচ্চ রক্ত চাপ সৃষ্টি করে। এটি শিশুদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করে, সন্তান উৎপাদন ও ধারণক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

কোবাল্ট: এটি ফুসফুস ,হৃৎপিণ্ড, চোখ ও থাইরয়েডের সমস্যা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। অ্যাজমার জন্যও কোবাল্ট দায়ী।

টিন: ত্বক ও চোখের চুলকানি, মাথার যন্ত্রণা, বদহজম, শ্বাসকষ্ট ও মূত্রাশয়ের রোগ সৃষ্টি করতে পারে এই উপাদানটি।

ক্যাডমিয়াম: এই উপাদানটি ফুসফুসের ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের সমস্যা, পাকস্থলির সমস্যা, আলসার ও অ্যালার্জি সৃষ্টি করে। অধিকমাত্রায় দেহে প্রবেশ করলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

মলিবডেনাম: হাত, পা, হাঁটু ও কনুই এ ব্যাথা সৃষ্টি করে।

এন্টিমনি: চোখ, ত্বক, হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের ক্ষতি করে।

পরবর্তি পর্বে চোখ রাখুন। চলবে...

 

তথ্যসূত্র- এলিটাস ডট কম ও এনভোয়োরনমেন্ট ডট ইইউ।

 

২১ জুলাই ২০২২, ০১:৩৯পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।