• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডিজিটাল আমনেসিয়া : স্মৃতিশক্তি ধ্বংসে স্মার্টফোনের দায়!

ডিজিটাল আমনেসিয়া : স্মৃতিশক্তি ধ্বংসে স্মার্টফোনের দায়!

প্রতিকী ছবি

ফিচার ডেস্ক

স্মার্টফোন বা প্রযুক্তিযন্ত্র কি আমাদের মস্তিষ্কের দখল নিতে চলেছে? স্মার্টফোন কি আমাদের স¥ৃতিশক্তির বিরাট অংশ অকেজো করে ফেলছে? নাকি আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা দিন দিন কমিয়ে দিচ্ছে প্রযুক্তিযন্ত্রগুলো। আমরা আমাদের ভবিষ্যত স্মার্টফোন কিংবা এসব যন্ত্রের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি না তো?

ভাবুন তো, আমাদের স্মৃতির কিছু অংশ যদি আমরা বাহ্যিক কোনো ডিভাইসে স্থানান্তর করি, তাহলে কী ঘটবে? আমরা কী স্মার্টফোনের ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে গেছি যে ভবিষ্যতে এ ফোনই ঠিক করে দেবে আমাদের মস্তিষ্ক বা স্মৃতি কীভাবে কাজ করবে?

স্মার্টফোন পুরো বিশ্বটাকেই যেন আমাদের হাতের মুঠোয় তুলে দিয়েছে। বর্তমানের স্মার্টফোনগুলো আরও শক্তিশালী। কাজেই পকেটে এত স্মৃতি নিয়ে চলার কারণে মানুষ তার মস্তিষ্ক ব্যবহারের প্রচলন থেকে সরে যাচ্ছে। এতে করে আমাদের মাথার ভেতরকার স্মৃতিক্ষমতা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে।

দীর্ঘকালীন চাপ, করোনাকালীন আইসোলেশন, ক্লান্তিভাব মানুষের স্মৃতিক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে। ২০২১ সালে করোনাকালীন এসব নিয়ে গবেষণা করেছেন ক্যাথেরিন লাভডে নামক এক গবেষক। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ৮০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন তাদের স্মৃতিশক্তি মহামারির পর আরও খারাপ হয়েছে।

ক্যাথেরিন লাভডে তার গবেষণাপত্রে বলেছেন, ‘আমাদের স্মৃতির কিছু অংশ আমরা যদি বাহ্যিক কোনো ডিভাইসে স্থানান্তর করি, তাহলে কী ঘটবে? আমরা কী স্মার্টফোনের ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে গেছি যে ভবিষ্যতে এ ফোনই ঠিক করে দেবে আমাদের মস্তিষ্ক বা স্মৃতি কীভাবে কাজ করবে?’

তবে বিখ্যাত স্নায়ুবিজ্ঞানী ও ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের কগনিটিভ নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক ক্রিস বার্ড বলেন, ‘আমরা সবসময়ই বাহ্যিক ডিভাইসে স্মৃতির স্থানান্তর করেছি। এই যেমন, স্মার্টফোন আসার আগে আমরা নোট লিখে রাখতাম। এসবগুলোই কার্যত আমাদের মস্তিষ্কের স্মৃতিক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে।’ যদিও ক্রিস বার্ড ও ক্যাথেরিন লাভডে’র এধরনের বক্তব্যের সঙ্গে অসংখ্য স্নায়ুবিজ্ঞানীর মতবিরোধ রয়েছে।

অধ্যাপক ক্রিস বার্ড বলছেন, ‘আমাদের মস্তিষ্কের মেমোরি প্রসেসের ক্ষেত্রে বাহ্যিক ডিভাইস ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি থাকার দরকার নেই। আমরা বরং এখন আরও বেশি কাজ করি। ডিভাইসগুলো আমাদের মস্তিষ্কের পক্ষে অন্য কাজে মনোযোগ দেয়া, ফোকাস করা বেশি সহজ করছে’।

এছাড়া কানাডার মনট্রিলের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অলিভার হার্ড কড়া সতর্কতা জানিয়েছেন। তিনি বলছেন- ‘আপনি যদি মনে রাখার চেষ্টা বন্ধ করে দেন, তাহলে আপনার স্মৃতি আরও দুর্বল হবে। এতে করে আপনি আরও বেশি ডিভাইস নির্ভর হয়ে পড়বেন।’

তিনি মনে করেন, স্মার্টফোনের কল্যাণে জীবনযাপন সুবিধাজনক হয়েছে সত্যি, কিন্তু এটি মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতায় প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। মস্তিষ্কের ক্ষমতা দিনে দিনে কমছে।

মি. হার্ড বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে জিপিএস ব্যবহার করলে মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটারের ঘনত্ব কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাধারণত একটি স্থানের মানচিত্র মনে রাখতে মস্তিষ্ককে যে পরিমাণ জটিল কাজ করতে হয়, স্মার্টফোনের কারণে তার ন্যূনতম অংশও করতে হয় না। যদিও মানচিত্র পড়া ও তা বোঝা বেশ কঠিন কাজ, যা স্মার্টফোন সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু এই কাজটি মাথা খাটিয়ে করার সুফল সুদীর্ঘ হতে পারে।

অলিভার হার্ড তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই বলছেন, ‘মস্তিষ্কের কাজকে এভাবে কমিয়ে ফেলার খেসারত হতে পারে ডিমেনশিয়া তথা স্মৃতিভ্রংশের মধ্যদিয়ে। মানুষ স্মার্টফোন নির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়ে স্মৃতিভ্রংশ বা ডিজিটাল আমনেসিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।

তবে এ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে স্মৃতিভ্রংশের ঘটনা খুব কম। গবেষণা বলছে, শিক্ষকরা বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তাদের মননকে ব্যবহার করেন, এ কারণেই তাদের স্মৃতিভ্রংশ কম।

বিজ্ঞান লেখক ক্যাথেরিন প্রাইস বলছেন, ‘আমাদের মস্তিষ্ক একসঙ্গে একাধিক কাজ করতে পারে না। আমাদের মনে হতে পারে মাল্টিটাস্কিং সম্ভব। কিন্তু আপনি যখন কাপড় ইস্ত্রি করছেন, তখন হয়তো রেডিও শুনতে পারবেন। কারণ রেডিও শোনার ক্ষেত্রে আপনার কোনো জ্ঞান কাজে লাগাতে হবে না। কিন্তু আপনি যদি ফোনে মনোযোগ দেন, তখন আপনার মনোযোগ আর অন্য কোথাও থাকে না। আপনি কোনো কাজে মনোযোগ না দিলে , সে কাজের স্মৃতি আপনার মস্তিষ্কে জমা হবে না।’

বর্তমান সময়ের আলোচিত এ বিষয়টি নিয়ে ২০১০ সালে একটি গবেষণাও হয়েছে। গবেষণার পর ক্যামব্রিজ বিশ^বিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী বারবারা সাহাকিয়ান তার মতামত জানিয়েছেন। তিনি বলছেন- ‘তিনটি দলকে বই পড়তে দেয়া হয়। পড়া শুরু আগে একটি দল টেক্সট মেসেজ পায়। আরেক দল পায় পড়ার মাঝখানে। শেষ দলকে কোনো মেসেজ পাঠানো হয়নি। পড়া শেষ হলে তাদেরকে যখন কী পড়েছে তা নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলো, দেখা গেল যারা মেসেজ পেয়েছিল, তারা মনে করতে পারেনি তারা কী পড়ছিল।’

বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজার শিশুকে নিয়ে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা চলমান রয়েছে। এ গবেষণা থেকে জানা গেছে, যেসব শিশু প্রযুক্তি বেশি ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্কের কর্টেক্স অনেক পাতলা, যেটা তাদের বৃদ্ধ বয়সে হওয়ার কথা ছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্টিকাল পাতলা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি স্বাভাবিক, এমনকি শেষ বয়সে এসে পারকিন্স, আলঝেইমার, মাইগ্রেন ইত্যাদি রোগ হওয়ার পেছনে এর সম্পর্ক রয়েছে।

স্মার্টফোন ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে, করণীয় কী?

বিখ্যাত স্নায়ুবিজ্ঞানী ল্যারি রসেন তার লেখা বইয়ে স্মার্টফোনের ব্যবহার ও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা নিয়ে কিছু কৌশলের কথা বলেছেন। এর একটি হচ্ছে ‘টেক ব্রেক’। অর্থাৎ প্রতি ১৫ মিনিট পরপর এক মিনিটের জন্য ফোন ব্যবহার করা। এই এক মিনিটই হচ্ছে ‘টেক ব্রেক’। এভাবে ১৫ মিনিটকে ক্রমে বাড়িয়ে তা যদি ৬০ মিনিট পর্যন্ত নেয়া যায়, তাহলে তাকে সাফল্য হিসেবে দেখছেন এ লেখক।

০৬ জুলাই ২০২২, ০৪:৩০পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।