• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে খুন হওয়া সাদিয়ার ডায়রি থেকে...

বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে খুন হওয়া সাদিয়ার ডায়রি থেকে...

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন ছিল সাদিয়া সাথীর। অদম্য মেধাবী মেয়েটি জীবনের নানা চড়াই-উতরায় পেরিয়ে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। পুরোদমে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করেই তার ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

পরিবারের অভিযোগ, সাদিয়ার স্বামী পুলিশ সদস্য মাইনুল এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত। তবে সাদিয়ার মৃত্যু নিয়ে রহস্যের শুরু হয়েছে তার লেখা চিরকুট ও ডায়রিকে ঘিরে। পুলিশের তদন্ত টিম সাদিয়ার একটি ডায়রি খুঁজে পেয়েছে।

ডায়রিতে স্বামী মাইনুলের প্রতারণা ও অবজ্ঞার বিষয়টি বারবার তুলে ধরেছেন সাদিয়া সাথী। স্বামীর কাছ থেকে বঞ্চণার শিকার সাদিয়ার মনে নানা কষ্টের কথা ডায়রিতে পেয়েছে পুলিশ। কাজেই ধারণা করা হচ্ছে, সাদিয়ার মৃত্যুর পিছনে তার স্বামী মাইনুলের প্ররোচনা ছিল।

নিহতের বাবা সিরাজুল ইসলাম বলেন, পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনায় বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে থানা-পুলিশ।

তবে কোতোয়ালি থানার ওসি আজিমুল করিম বলেন, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলেই সাদিয়া সাথী হত্যার কারণ উদঘাটন হবে। তখন অভিযুক্তের প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া বর্তমানে একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।

এদিকে সাদিয়া সাথীর লেখা ৯টি চিঠিই ছিল গোয়েন্দা পুলিশ সদস্য মাইনুল ইসলামকে নিয়ে। সাদিয়া সাথীর বড় বোনের স্বামী কেদারপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূরে আলম বেপারী বলেন, সাথীকে প্রথমে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওর প্রথম স্বামী ছিলেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মী। সাদিয়া চাকরি করতে ইচ্ছা পোষণ করায় প্রথম স্বামীর দ্বিমত থাকায় সেই সংসার ভেঙে যায়।

সাদিয়া সরকারি ব্রজমোহন কলেজে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী ছিল। ওই কলেজ থেকে ইংরেজিতে লেখাপড়া শেষ করে বিসিএস ক্যাডার হতে চেয়েছিল। ওর জীবনে একটাই ইচ্ছা ছিল যত বাধাই আসুক বড় সরকারি চাকরি করতে হবে। এজন্য বিসিএস কোচিং করত এবং বাসায় প্রচুর লেখাপড়া করত। কোচিংয়ের শিক্ষকরা আমাকে বলেছে, ওর লেখাপড়ায় আমরা ধরে নিয়েছি ৪৪তম বিসিএসে বরিশালে একজন যদি চান্স পায় সেটি হবে সাদিয়া সাথী। কিন্তু তা তো আর হলো না।

সাদিয়া সাথির বাবা সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমার মেয়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ প্রতারণা করেছে। সে (মাইনুল) নিজে কনস্টেবল হলেও আমাদের কাছে এসআই পরিচয় দিত। সাদিয়ার কাছেও সেই পরিচয় দিয়েছে। তাছাড়া তার আরেকটি সংসার রয়েছে। সেই ঘরে দুটি সন্তান আছে। এসব তথ্য আমরা জেনেছি সাদিয়ার মৃত্যুর কয়েক দিন আগে। এই নিয়ে দুইজনের মধ্যে বেশ দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল।

সাদিয়ার লেখা ডায়েরিতেও বার বার উল্লেখ করা হয়েছে ডিবির কনস্টেবল মাইনুলের প্রতারণার কথা। উল্লেখ আছে মাইনুলের জন্য ভালোবাসার হাহাকার। একটু মানসিক শান্তি ও আশ্রয়ের আকুতি।

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রাতে সাদিয়া মাইনুলকে পাখি সম্মোধন করে লিখেছেন, ‘নিজেকে শান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। তবে একটা কথা মনকে বোঝাই, এই পৃথিবীতে অনেকের অনেক অঙ্গ-প্রতঙ্গ নেই; আর আমার নেই তুমি।...আজ সারাদিন তোমাকে মিস করেছি। তাই আগামীকাল থেকে রোজা রাখব।’

ডায়রির আরেক পাতায় সাদিয়া লিখেছেন, ‘আমাকে পারতেই হবে। সমস্ত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সফলতার দ্বারপ্রান্তে যাওয়ার জন্য আমি রেডি। তুমি আমার পেছন থেকে পালিয়ে যেও না। আমি যেন হাত বাড়ালে তোমাকে পাই মাইনুল।...দিন শেষে তোমার কাছে একটু ভালো আচরণ ও ভালোবাসা, সম্মান চাই। চাকরিটা হয়ে গেলে আর তোমার কাছে টাকার জন্য হাত পাতব না।’

আরেক লাইনে লিখেছেন, ‘আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না। আমি তোমার দাসী হয়ে থাকতে চাই। আর সংসার নষ্ট করতে চাই না।’

তবে ৫ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখ উল্লেখ করে সাদিয়া তার ডায়রিতে লিখেছেন, ‘আজ আমি দুর্বল পরিবারের গাফিলতির কারণে। আমি খারাপ, জীবনে কাউকেই পাগলের মতো ভালোবেসেও ধরে রাখতে পারিনি বলে। আমি খারাপ, একটি সন্তান পৃথিবীর আলো দেখেছে বলে।...আমি খারাপ তোমার হাজারটা মিথ্যা কথার ওপর ভরসা করি বলে।’

তারিখ ছাড়া আরেকটি পাতায় লিখেছেন, জীবনে কিছুই পাইনি। বারবার পুরুষ লোকের প্রতারণার কাছে হেরে গেছি। নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছিলাম তোমাকে। একটু আশ্রয় চেয়েছি খারাপ মানুষের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আমি তোকে বিশ্বাস করে ঠকেছি। তোকে তো টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার সবই দিয়েছিলাম। তাহলে কেন এমন করলি? এত মিথ্যা কেন বললি? কী অপরাধ করেছি? জীবনের কাছে হেরে গেলাম। ঠকে গেলাম। তুই জিতে গেলি। ভালো থাকিস মাইনুল।

হত্যার শঙ্কা প্রকাশ করে সাদিয়া ডায়েরির আরেক পাতায় লিখেন, ‘আমি পারিনি তোমাকে ঠকাতে। হয়তো কোনো দিন পারবও না। তোমার সমস্ত সত্যি জেনে গেছি। হয়তো আমাকে মেরে ফেলবে। পথের কাটা আমি এখন তোমার।’

৩ মার্চ ২০২২ তারিখে লেখা ডায়েরির পাতায় সাদিয়া উল্লেখ করেছেন, ওরা সকলে বলেছিল তুমি আমার সঙ্গে টাকার জন্য অভিনয় করেছ, আমি বিশ্বাস করিনি। আমি বিশ্বাস করেছি তোমাকে। তার বিনিময়ে সব কিছু হারিয়ে আজ আমি নিঃস্ব। তুমি আমাকে মারছ প্রতি মিনিটে মিনিটে। তবে তুমি ভালো থাকো। সবশেষ তোমার শান্তি কামনা করি।

প্রসঙ্গত, গত সোমবার (৭ মার্চ) বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ২০ নং ওয়ার্ড বৈদ্যপাড়ায় একটি ভবনের ৫ তলা থেকে সাদিয়া আক্তার সাথী নামে এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সাদিয়া আক্তার সাথী ও বরিশাল জেলা ডিবির কনস্টেবল মাইনুল ইসলাম এক বছর আগে প্রেম করে বিয়ে করে বরিশালে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন।

১১ মার্চ ২০২২, ০৩:১৪পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।