• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘হৃদয়ের মনিকোঠায় বঙ্গবন্ধু’

‘হৃদয়ের মনিকোঠায় বঙ্গবন্ধু’

ফাইল ছবি

মাহমুদা সুলতানা শিমু

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন- সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান(১৭ই মার্চ ১৯২০-১৫ই  আগস্ট ১৯৭৫)। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ভারত বিভাজন আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে  প্রতিষ্ঠা  সংগ্রামে কেন্দ্রিয় ভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু এমন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব; যার দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা, প্রজ্ঞা, বাগ্মিতা, নেতৃত্বগুণ, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, রসবোধ ইত্যাদি তাকে বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। তিনি সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন যা সম্মিলিতভাবে 'মুজিববাদ' নামে পরিচিত।

পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন অর্জনের প্রয়াস এবং পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনের  কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে  তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বাংলাদেশের 'জাতির জনক 'বা 'জাতির পিতা' হিসেবে অভিহিত করা হয়।জনসাধারণের কাছে তিনি 'শেখ মুজিব' বা 'শেখ সাহেব' নামে এবং তাঁর উপাধি "বঙ্গবন্ধু" হিসেবেই অধিক পরিচিত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে তাঁর অবিনাশী চেতনা ও আদর্শ চির প্রবহমান থাকবে।তিনি তৎকালীন বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন।জনগণের স্বাধিকার  প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ছয়দফা স্বায়ত্তশাসন পরিকল্পনা প্রস্তাব করেন যাকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনা হিসেবে ঘোষণা করেছিল। বঙ্গবন্ধু একটা জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন  দেখিয়েই ক্ষান্ত  থাকেননি, দিনের পর দিন  লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন স্বাধীনতার জন্য এবং সত্যি সত্যিই তিনি সেই দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১। টানা চব্বিশ বছরের সেই সংগ্রাম যেন এক মহাকাব্য, যেই কাব্যের ধারাবাহিকতায় কখনো ছয় দফা ,কখনো বা সরাসরি ঘোষণা-

"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" নির্মলেন্দু গুণ তাঁর কবিতায় বলেছেন, " কে  রোধে  তাঁহার  বজ্রকন্ঠ বাণী? গণসূর্যে  মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তারঁ অমর কবিতাখানি।"

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের  ভাষণ ছিল একটি অগ্নিমশাল যা বিস্ফোরিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের দাবানল যার সামনে টিকতে পারেনি হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।জাতির জনকের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়কেই নাড়া  দেয়নি,ভাষণটি সারাবিশ্বে  আলোড়ন  সৃষ্টি করেছিল। তিনি একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে কিউবার  অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন, "৭ মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধু মাত্র ভাষণ  নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।" 'নিউজ উইক' সাময়িকীর বিখ্যাত রিপোর্ট, যেখানে বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করা হয়েছিলো 'পোয়েট অব পলিটিক্স’ হিসেবে। ৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয় এটি একটি অনন্য কবিতা, এই কবিতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান।

ফিলিস্তিন মুক্তি মোর্চার সাবেক নেতা নোবেল বিজয়ী ইয়াসির আরাফাত  বলেছেন,"আপোষহীন  সংগ্রামী নেতৃত্ব ও কুসুম কোমল  হৃদয় ছিল মুজিবের চরিত্রের বিশেষত্ব।' কিউবার মহান বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাতের পর বলেছিলেন,"আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।  ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়।"

যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন এক অনন্য নেতা; সহজ সরল, সাদামাটা অথচ দৃঢ়চেতা একজন  মানুষ। ৫২থেকে ৭১ পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে তিনি ছিলেন সংগ্রামী জনতার পুরো ভাগে। তাঁর রাজনীতির মূল মন্ত্রই ছিল আদর্শের জন্য সংগ্রাম,আদর্শের জন্য ত্যাগ। যে আদর্শ বিশ্বাস ও স্বপ্ন নিয়ে তিনি রাজনীতি করতেন শত কষ্ট ও প্রচণ্ড চাপেও তিনি তাতে  অটল ছিলেন।

বস্তুত জেল জুলুম ও নিপীড়ন বঙ্গবন্ধুর জীবনে এক নিয়মিত অধ্যায়ে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবনের ১৪টি বছর কারাগারে ছিলেন। তিনি ৪৬৮২দিন কারাগারে ছিলেন। ব্রিটিশ আমলে স্কুল জীবন থেকে শুরু হয় তাঁর কারাবরণ। এসময় তিনি সাত দিন কারাভোগ করেছেন।  বাকি ৪৬৭৫ দিন কারাভোগ করেছেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। ৫৪ বছরের জীবনের এক-চতুর্থাংশ সময় কারাগারে কাটাতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে।

নিজের অদম্য নেতৃত্ব এবং দক্ষ যোগাযোগ কৌশলের মাধ্যমে বাঙালির প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার মত নদী -ছায়াঘেরা একটি প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নিয়েও করেছিলেন বিশ্বজয়। ১৯৪৭ সালের পর থেকে  আমৃত্যু বাঙালি জাতির প্রধান আকর্ষণ ছিলেন তিনি। তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে বাঙালি জাতির মুক্তির ইতিহাস। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি।১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। প্রতিষ্ঠিত হয় জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ।আর এই স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি সোনার বাংলা  চেয়েছিলেন। তাঁর ডাকে সাড়া  দিয়ে সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করে। সেই তাকেই পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ভোরে। আমরা বড় অভাগা জাতি এমন বিশ্ব নেতা কে স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় সপরিবারে হত্যা করা হয় এই দেশেই। যে পাকিস্তানিরাও সাহস করেনি  তাকে হত্যা করতে স্বাধীন দেশে  সেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল।

এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তারা চেয়েছিল বাংলার মাটি থেকে চিরতরে পিতার নাম মুছে ফেলতে কিন্তু তাকে বাংলার মাটি থেকে, বাঙালির মন থেকে মুছে ফেলা যায় নি। দেশের কোন না কোন প্রান্তে প্রতিমুহূর্তে জাতির পিতার মুখ আঁকা হচ্ছে বাংলা ভাষার কোন না কোন কবির  কলমে ছন্দে এবং শব্দে। এই মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায় এর যথার্থ উচ্চারণ-

 "যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মজিবর রহমান।"

তাঁর নাম বাংলার মাটিতে, বাংলার কথায়, বাঙালির জাতিসত্তায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে আজীবন। তিনি বাঙালির মধ্যমণি হয়ে থাকবেন চিরদিন। তাঁর অসামান্য নেতৃত্বের দক্ষতার মাধ্যমে দেশের সর্বস্তরের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধ অনুপ্রাণিত করতে। জীবন বাজি রেখে লড়ে গিয়েছেন শত্রুদের বিরুদ্ধে। ছিনিয়ে এনেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং আমাদের উপহার দিয়েছেন  একটি স্বাধীন  রাষ্ট্রের।আমরা পেয়েছি নতুন পতাকা, নতুন মানচিত্র এবং স্বাধীনতার স্বাদ।

ইতিহাসে তিনি অমর,  যিনি তার স্বপ্নের বাস্তবায়নের  মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করেছেন। ইতিহাস  তাকে সৃষ্টি করেনি তিনিই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।তিনি দুঃখী মানুষের হাসি ফোটানোর জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম ও কর্মের মধ্য দিয়ে যে দর্শন, নীতি ও আদর্শ আমাদের সামনে রেখে গিয়েছেন তাকে অনুসরণ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাঁর আদর্শ অনুসরণ করলেই একজন ব্যক্তি সুনাগরিক ও আদর্শ মানুষ হয়ে উঠতে পারে।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে বিশ্বসভায় একটি উন্নয়নশীল মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। সারাবিশ্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল।

লেখক পরিচিতি

মাহমুদা সুলতানা শিমু,
বি,এ, এম,এ (বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ),
প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৪:১১পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।