• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
টিআইবি’র গবেষণাপত্র প্রকাশ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম!

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম!

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি, শিক্ষক বদলী ও নিয়োগে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠে এসেছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, বিদ্যালয়ের গর্ভনিং বডি ও ব্যবস্থাপনা কমিটির যোগসাজশে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে।

‘মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে বিদ্যালয়গুলোতে সহকারী গ্রন্থাগারিক নিয়োগে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়। এছাড়া শিক্ষক এমপিওভুক্তিতে ৫ থেকে ১০ হাজার ও শিক্ষক বদলিতে এক থেকে ২ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়। ঘুষের এসব অর্থ মধ্যসত্বভোগী ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা ভোগ করেন বলেও গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে।

বুধবার টিআইবি কার্যালয় থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির গবেষক তাসলিমা আক্তার গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেন। এ সময় সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন।

ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নয়। এছাড়া জাতীয় বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ টাকার অংকে ক্রমান্বয়ে বাড়লেও শতাংশের ক্ষেত্রে এটি গড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। শিক্ষক ও কর্মচারীর জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অনুপস্থিতি রয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমন্বিত জনবল কাঠামোর অনুপস্থিতি এবং জনবল সক্ষমতার ঘাটতিতে সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান ও পরিদর্শনের অভাব রয়েছে।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে পদক্ষেপের ঘাটতিতে অনিয়ম-দুর্নীতি বাড়ছে দাবি করে তিনি আরও বলেন, শিক্ষা কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব, অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির বিষয় চলে আসছে। এসব অভিযোগ অব্যাহত ভাবে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।

সংস্থাটির গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় নীতিমালা লঙ্ঘন করে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তালিকায় অন্তর্র্ভূক্ত হয়ে যাচ্ছে। একই প্রক্রিয়ায় শিক্ষক ও কর্মচারীরাও এমপিওভুক্ত হচ্ছেন।

এছাড়া এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে গভর্নিং বডি কর্তৃক রাজনৈতিক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি ও নিয়ম-বহির্ভূত অর্থ আদায় করা হচ্ছে। যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে বলেও গবেষণাপত্রে অভিযোগ করা হয়েছে।

টিআইবির গবেষণাপত্রে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) কর্তৃক সুপারিশকৃত শিক্ষকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানের সময় প্রার্থীর কাছ থেকে ‘প্রতিষ্ঠানের তহবিল গঠন, উন্নয়নমূলক কাজ, পূর্বে এসএমসি/গভর্নিং বডি কর্র্র্তৃক নিয়োগে অনেক টাকা দিতে হতো’ সহ নানা অজুহাতে নিয়ম-বহির্ভূত ভাবে অর্থ আদায় করা হয়।

এছাড়া সরকারি শিক্ষক ও কর্মকর্তা বদলির ক্ষেত্রে সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী তিন বছর পর পর বদলির বিধান থাকলেও তা নিয়মিত হয় না বলে টিআইবির গবেষণাপত্রে অভিযোগ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কলেজের একজন শিক্ষক দীর্ঘ ১০ বছর বা এর অধিক একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে এটি ১০-১২ বছরের অধিক। আবার কোথাও কোথাও এটি ২০ বছর পর্যন্ত পাওয়া গেছে।

টিআইবি বলছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের মাধ্যমে পাঠদান ও একাডেমিক স্বীকৃতির অনুমোদন সম্পন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু এই অনুমোদন পেতে মোটা অঙ্কের অর্থ ঘুষ হিসেবে দিতে হয়। ঘুষগ্রহণ সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে অনুমোদনের জন্য কাজ করতে গিয়ে বছরের পর বছর ভোগান্তির শিকার হয়েছেন অনেকে।

গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে, আইসিটি প্রকল্প-২ এ প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, সার্টিফিকেট, প্রশিক্ষণ সামগ্রী ক্রয় বাবদ দরপত্র ছাড়াই দুই কোটি ২৫ লাখ দুই হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালকের বছরে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করার ক্ষমতা থাকলেও ৯৬ কোটি টাকা অগ্রিম তোলার ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেয়া হয়নি। একই সময়ে অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণে উপস্থিত না থেকেও প্রকল্প পরিচালক সম্মানী নিয়েছেন প্রায় ১৭ লাখ টাকা। এছাড়া ছয় দিনের ইন-হাউজ প্রশিক্ষণটি কোথাও তিন দিনে, কোথাও আধাবেলা করে তিন থেকে ছয়দিনে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে গবেষণাপত্রে উঠে এসেছে।

টিআইবি বলছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নথিপত্রের বিভিন্ন দুর্বলতায় পরিদর্শককে ম্যানেজ করতে নিয়ম-বহির্ভূত অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। ‘পরিদর্শনে অডিটর আসছে’ বলে শিক্ষকদের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং পরিদর্শককে ম্যানেজ করার কথা বলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঘুষ লেনদেন করা হয়। অধিকাংশ সময় প্রধান শিক্ষকরা এই কাজে জড়িত থাকেন।

এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রয়োজনীয়তা যাচাই না করে রাজনৈতিক সুপারিশে প্রতি বছরই অর্থ বরাদ্দ করা হয়। বরাদ্দকৃত এসব অর্থ অধিকাংশ সময়ই কাজে লাগানো হয় না। রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডি ও ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতৃত্বে থাকায় এই আর্থিক অনিয়মে তাদের জড়িত থাকার অভিযোগও পাওয়া যায়।

 

এবি/এসএন

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৫:২৬পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।