• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
রাজধানীতে নৈশপ্রহরীর লাশ উদ্ধার

ছেলেকে হারিয়ে প্রতিবন্ধী নাতি নিয়ে বিপাকে শতবর্ষী বৃদ্ধা

ছেলেকে হারিয়ে প্রতিবন্ধী নাতি নিয়ে বিপাকে শতবর্ষী বৃদ্ধা

নিহত আলমগীরের বৃদ্ধ মা ও দুই সন্তান।

রাশেদ হাসান

তিন সন্তান আর শতবর্ষী মাকে নিয়ে ছিল আলমগীরের সংসার। রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় সন্তান আর মাকে নিয়ে বসবাস করতেন চা দোকানী আলমগীর। চায়ের দোকান চালিয়ে সবার ভরণপোষণ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। যে কারণে বড় মেয়েকে নিজ গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার দাউদখালি গ্রামে পাঠিয়ে দেন। দুই স্ত্রী তাকে ছেড়ে গেলেও শতবর্ষী মা ও সন্তানদের আগলে রেখেছিলেন চা দোকানী আলমগীর হোসেন (৩৫)। সংসারের খরচ মেটাতে চায়ের দোকান চালানোর পাশাপাশি পার্টটাইম নৈশপ্রহরীর কাজ করতেন তিনি। তাতে কোনো মতে চলে যাচ্ছিল প্রতিবন্ধী সন্তান আর বৃদ্ধা মাকে নিয়ে আলমগীরের সংসার।

কিন্তু সব যেন এলোমেলো হয়ে গেছে মুহূর্তেই। শুক্রবার রাতে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার লা-মেরিডিয়েন হোটেলের সামনে রাস্তার পাশে পড়ে ছিল আলমগীর হোসেনের (৩৫) নিথর দেহ। পুলিশের ধারণা, আলমগীর হয়তো হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। কারণ, আলমগীরের লাশের পাশেই পড়ে ছিল রক্ত মাখা লাঠি। তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করতে চাইছে না পুলিশ।

তবে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা আমেনা বেগম। তাঁর আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। নিহত যুবকের দুই সন্তানের ভরণপোষণ নিয়েও চিন্তিত শতবর্ষী বৃদ্ধা। ছেলে হারানোর শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি।

পরিবার, পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার রাতে নৈশপ্রহরীর কাজে গিয়েছিলেন আলমগীর। শুক্রবার ভোরে রক্তাক্ত অবস্থায় তার লাশ রাস্তার পাশে পাওয়া যায়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান নিহত আলমগীরের বড়ো ভাই আবদুল হামিদ। পরে পুলিশকে খবর দিলে তারা লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠায়।

আলমগীর চলে গেছে পরপারে। তিনি রেখে গেছেন তিন অবুঝ সন্তান আর তার শতবর্ষী মা আমেনাকে। সন্তানদের মধ্যে বড় ছেলে প্রতিবন্ধী। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল আলমগীর। তার অকালে চলে যাওয়ায় তিন সন্তানের ভার পড়েছে বৃদ্ধ আমেনা বেগমের ওপর। আলমগীরের মৃত্যুর পর থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে তার চায়ের দোকান।

মৃত আলমগীরের প্রতিবন্ধী দুই সন্তানকে পাশে নিয়ে তার জীর্ণ কুটিরে বসে বিলাপ করছেন তার শতবর্ষী বৃদ্ধা মা আমেনা বেগম। আমেনা বেগম আহাজারি করে বলেন, ‘আমি নিজেই একা দাঁড়াতে পারি না, ওদের (নিহত আলমগীরের সন্তান) ক্যামনে দেখমু। আলমগীর নেই এখন আমাগো খাওন দিবো কেডা? আমাগো দেখবো কেডা?’

নিহত আলমগীরের প্রথম স্ত্রীর সংসারে প্রতিবন্ধী সন্তান আল আমিনের জন্ম হয়। জন্মের তিন বছর পর তাদের বিচ্ছেদ হয়। সেই ছোট্ট আল আমিনের বয়স এখন পনের বছর। শারীরিক অক্ষমতার কারণে সে কোনো কাজ করতে পারে না। আল আমিনের দুটি চোখই অন্ধ।

নিহত আলমগীরের দ্বিতীয় স্ত্রীর সংসারে দুই মেয়ের জন্ম হয়। বড়ো মেয়ে খাদিজা (৮) এবং মাইসা (৪)। ছোট মেয়ে মাইসা জন্ম নেয়ার দুই বছর পর দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথেও ছাড়াছাড়ি হয় আলমগীরের। বড়মেয়ে খাদিজা আলমগীরের গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধায় থাকে।

প্রতিবন্ধী ছেলে আল আমিন, মেয়ে মাইসা ও শতবর্ষী মাকে নিয়েই ছিল আলমগীরের সংসার। কিন্তু আলমগীরের অকাল মৃত্যুতে সন্তানের ভার পড়েছে বৃদ্ধা দাদী আমেনা বেগমের ওপর। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন আলমগীর। তার মৃত্যুতে পুরো পরিবার এখন দিশেহারা।

নিহত আলমগীরের মা আমেনা বেগম দৈনিক আমরাই বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার চিন্তা আমি করি না, আমি আলমগীরের রেখে যাওয়া পোলা মাইয়াদের ক্যামনে খাওন দিমু? ওদের দেখবো কেডা? আল্লাহ এতো নিষ্ঠুর হইতে পারে না। আলমগীরের চারটা ছাগল ছিল, ও মরার পরের দিন সেই ছাগল চারটাও মারা গেছে। আমরা বাচুম কি দিয়া?

আমেনা বেগম বিলাপ করে বলেন, ‘যারা আমার আলমগীর'রে মারছে আল্লাহ তাগো বিচার করুক। পুলিশ যেন তাদের ধরে শাস্তি দেয়।’

নিহত আলমগীরের ভাই আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমার ভাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে আমরা তাদের শাস্তি চাই। আমার ভাই আলমগীরের লাশের পাশে যে লাঠি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছে সেই লাঠি ওখানেই পড়ে ছিলো, পুলিশ সবকিছু দেখেছে।’

আবদুল হামিদ আরও বলেন, ‘আলমগীরের সাথে প্রায় চার মাস আগে এখানকার হুমায়ুনের সাথে হাঁস নিয়ে ঝগড়া হয়। ঝগড়ার এক পর্যায়ে হুমায়ূন আলমগীরকে রড দিয়ে মাথায় আঘাত করে। পরে আমরা তার চিকিৎসা করাই। সেই সময় আলমগীরের মাথায় ১৪টা শেলাই দিতে হয়েছিল। সেই মামলা এখনো চলমান আছে।’

সিকিউরিটি গার্ড পরিচালনা প্রতিষ্ঠান সততা স্মার্ট লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নয়ন মাহমুদ বলেন, ‘আলমগীর এই সিকিউরিটি কোম্পানিতে পার্ট টাইম কাজ করতো। অল্প কয়েকদিন ধরে এখানে কাজ করছিল সে। গত শুক্রবার হঠাৎ শুনলাম আলমগীর নাকি মারা গেছে। আমরা তার পরিবারকে সব রকম সহযোগিতা করবো।’

খিলক্ষেত থানার উপ পরিদর্শক সুধাংশু সরকার দৈনিক আমরাই বাংলাদেশকে বলেন, ‘শুক্রবার ভোরে খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠাই। কিভাবে তার মৃত্যু হয়েছে সেটা এখনো স্পষ্ট বলা যাচ্ছে না। ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছি। আমি আমার উর্ধতন স্যারদের নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত করছি। তদন্ত চলছে, খুব শীঘ্রই আসল রহস্য উন্মোচন হবে।’

০১ আগস্ট ২০২২, ০৪:০২পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।