• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অবসর পেলেই কোরআনে মশগুল হন গাড়ি চালক ফরিদ

অবসর পেলেই কোরআনে মশগুল হন গাড়ি চালক ফরিদ

তাহজিব হাসান

ব্যস্ত শহর ঢাকা। চারিদিকে কোলাহল। তবে রাজধানীর সার্কিট হাউজ রোডের শান্ত শীতল ছায়া থেকে ভেসে এলো পবিত্র কোরআনের বাণী। সুমধুর কণ্ঠে কোরআন তিলাওয়াত শুনে জানা গেল জীবনযুদ্ধে জয়ী এক নিভৃতচারী বিশ্বাসী মানুষের জীবনের গল্প। ফরিদ আল মাহমুদ নামের যুবকের বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়া থানার নীলগঞ্জ ইউনিয়নে। পেশায় প্রাইভেটকার চালক ফরিদ সুযোগ পেলেই কোরআন তিলাওয়াতে মশগুল হন।

বুধবার বিকালে রাজধানী ঢাকার সার্কিট হাউজ রোডে গাড়ি পার্কিং করে কোরআন তিলাওয়াত শুরু করেন তিনি। বিষয়টি নজরে পড়ে আমরাই বাংলাদেশের। এসময় গাড়িচালক ফরিদ আল মাহমুদের সঙ্গে কথা হয় তাহজিব হাসান এর।

গাড়ি চালানোর সময় অবসরে কোরআন তিলাওয়াত কেন করেন, এ বিষয়ে ফরিদ আল মাহমুদ বলেন, “আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। আমরা খালি হাতে দুনিয়াতে এসেছি, খালি হাতেই দুনিয়া থেকে বিদায় নেব। দুনিয়াতে যে ভালো কাজ করবে, আখিরাতে সে ভালো ফল পাবে। আর যে ব্যক্তি দুনিয়াতে খারাপ কাজ করে মারা যাবে, সে পরকালে তার ফল ভোগ করবে। এজন্য পৃথিবীতে যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষন আল্লাহকে স্মরণ করার চেষ্টা করি। দুনিয়াতে টাকা ছাড়া যেমন কোনো মূল্য নেই, আখিরাতে ভালো কাজ বা সওয়াব ছাড়া কোনো মূল্য থাকবে না।”

প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া না জানা গাড়িচালক ফরিদ আরও বলেন, “২০ বছর বয়সে ঢাকায় চলে আসি। তথন এক মেসে থাকতাম। ওই মেসের এক ভাই (নাহিদ) আমাকে বাংলা লেখা ও পড়া শিখিয়ে দেন।”

‘কোরআন শিখলেন কিভাবে’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি মাদ্রাসায় পড়াশুনা করিনি। স্কুল-কলেজেও পড়িনি কখনো। মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছ থেকে কোরআন পড়াটা শিখেছি। আমার মনে হয়েছে যে, আমি একজন মুসলিম, কোরআন পড়তে শেখাটা আমার উচিত। তাই ইমাম সাহেবের কাছ থেকে কোরআন পড়াটা শিখেছি।”

অল্প বয়সে বাবা-মায়ের আদর বঞ্চিত ফরিদ আল মাহমুদ জানান, জন্মের তৃতীয় দিন তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তার বাবা অন্য জায়গায় চলে যান। আর ফরিদের বয়স যখন তিন বছর, তখন তার মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়। এরপর নানা বাড়িতে বড় হতে থাকেন ফরিদ আল মাহমুদ।

বাবা-মা কেউ খোঁজ নেই না জানিয়ে ফিরোজ আল মাহমুদ বলেন- “আমার বাবা-মায়ের আলাদা আলাদা সংসার আছে। তাদের সন্তানাদিও আছে। তারা কেউ আমার খোঁজ খবরও নেই না। আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। খোঁজখবর নিই।”

নিজের বিয়ের খবর নিশ্চিত করে ফরিদ বলেন, “নিজের এলাকা পটুয়াখালীতেই আমি বিয়ে করেছি। আমার ৮ বছরের একটি মেয়ে আছে। আমি যখন গাড়ি চালায়, তখন সব সময় পরিবারের কথা মাথায় রাখি। আমার স্ত্রী নিজ হাতে চাল, তিল ও চিড়া ভেঁজে কৌটায় ভরে দিয়েছে। রাস্তায় ক্ষুধা লাগলে মাঝে মাঝে একটু খেয়ে নিই।”

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়েন ফরিদ আল মাহমুদ। কাজের ব্যস্ততা থাকা সত্বেও কিভাবে তিনি নামাজ আদায় করেন, সে ব্যাপারে বলেন, “আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি মুসলিম। পৃথিবীতে কোনো মানুষই একা নয়। আল্লাহ সব সময় তার প্রিয় বান্দাদের সঙ্গে থাকেন। আমার সঙ্গে সবসময় একটি জায়নামাজ রাখি। নামাজের সময় হলেই আমি নামাজ পড়ে নিই। নামাজ পড়া নিয়ে অনেকেই অজুহাত দেয়। আসলে নামাজের জন্য কোনো কিছু বাধা নয়।”
নিজের গাড়ির মালিক সম্পর্কে তাকে সহায়তা করেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ফরিদ বলেন, “আমার সাহেব (গাড়ির মালিক) অনেক ভালো মানুষ। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। আমাকেও নামাজের জন্য তাগিদ দিতেন। আমার সাহেব অত্যন্ত ভালো মানুষ।”

নিজের চালানো গাড়িটি সম্পর্কেও যথেষ্ট অবগত ফরিদ আল মাহমুদ। নিজের চালানো গাড়ি সম্পর্কে তিনি বলেন, “গাড়িটি নিশান ব্র্যান্ডের। এই গাড়িটির ফিচার খুবই চমকপ্রদ। হাইওয়েতে এই গাড়িটি চালিয়ে যেমন মজা, মাইলেজও দারুণ। গাড়ির এসি খুবই পাওয়ারফুল। সিটের সাইজও বেশ বড়। হাইব্রিড প্রযুক্তির গাড়িটি চালিয়ে আমি খুবই মজা পায়।”

সড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা। এ নিয়ে ফরিদ আল মাহমুদও চিন্তিত। দুর্ঘটনা রোধে কি করণীয়, সেটাও জানান স্বশিক্ষিত ফরিদ। তিনি বলেন, “সড়কে অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালানো কোনো ভাবেই ঠিক নয়। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের চাহিদা পূরণের জন্য আমরা গাড়ি চালাই। কাজেই পরিবারের কথা মাথায় রেখেই আমাদের রাস্তায় গাড়ি চালানো উচিত। মনে রাখতে হবে, পরিবারের সবাই বাসায় আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কাজেই নিরাপদে গাড়ি চালিয়ে আমাকে সুস্থভাবে বাসায় ফিরতে হবে। আর তাই, অতিরিক্ত গতি ও নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি চালানো পরিহার করতে হবে।

ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা সকল চালকদের অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়ে ফরিদ আল মাহমুদ বলেন, “দুর্ঘটনা ঘটুক, এটা কোনো চালকই চায় না। তারপরও দুর্ঘটনার জন্য চালকদের দায় থাকেই। কারণ আমরাই যখন ক্যান্টমেন্টের ভেতরে গাড়ি চালায় তখন সবাই কত সুন্দর করে নিয়ম মেনে গাড়ি চালাই। আবার যখনই ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাইরে আসি, তখনই আমাদের গাড়ি চালানোর স্টাইল চেঞ্জ হয়ে যায়। আমরা যদি আইন মেনে রাস্তায় নিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালাই তাহলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক কমে যাবে।

২৮ জুলাই ২০২২, ০৭:৫৯পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।