‘পল্লীকবি’ পদ্মাপাড়ের জসিম উদ্দীন
![‘পল্লীকবি’ পদ্মাপাড়ের জসিম উদ্দীন ‘পল্লীকবি’ পদ্মাপাড়ের জসিম উদ্দীন](https://amrai-bangladesh.com/public/np-uploads/content/images/2021April/jashim-uddin-20230212165319.jpg)
ফাইল ছবি
বাংলা সাহিত্যের গ্রামীণ হিরো ‘রুপাই’। যেই চরিত্রের মাঝে ফুটে উঠেছে বংশীবাদক রাখাল ছেলের গল্প আবার কখনো শক্তিমান লাঠিয়াল যুবকের হিম্মত। বাংলা সাহিত্যে গ্রামীণ সামাজিক রীতি ও ঘটনাপ্রবাহের দারুণ এক সাহিত্য স্রষ্ঠা কবি জসীম উদ্দীন। তিনি বাংলাদেশের ‘পল্লীকবি’। আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি তিনি। ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগরসভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীম উদ্দীনের। জসিম উদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার উৎকৃষ্টতম নিদর্শনগুলোর অন্যতম।
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ণ নাম মোহাম্মাদ জসীম উদ্দীন মোল্লা। বাবার নাম আনসার উদ্দিন মোল্লা। তিনি ছিলেন পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক। জসিম উদ্দীনের মায়ের নাম আমিনা খাতুন। সাবেক আইনমন্ত্রী ও বরেণ্য রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী জসিম উদ্দীনের দুই জামাতা।
শিক্ষা ও কর্মজীবন
ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল ও ফরিদপুর জেলা স্কুলে পড়ালেখা শুরু করেন জসিম উদ্দীন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে বি.এ. এবং এম.এ. শেষ করেন। এরপর ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত ড. দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে লোক সাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে জসীম উদ্দীন কাজ করেন। তিনি পূর্ববঙ্গ গীতিকার একজন সংগ্রাহকও। জসিম উদ্দীন ১০ হাজারের বেশি লোক সংগীত সংগ্রহ করেছেন। এসব সংগীত সংকলন জারি গান এবং মুর্শিদা গান এ স্থান পেয়েছে।
১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগ দেন জসিম উদ্দীন। এরপর ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ‘পল্লীকবি’। তিনি ১৯৪৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে এবং তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করে গেছেন।
অর্জন
১৯৬৯ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবি জসিম উদ্দীনকে সম্মান সূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার, ১৯৭৬ সালে একুশে পদক ও ১৯৭৮ সালে জসিম উদ্দীন স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত হন। এ ছাড়া ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন জসিম উদ্দীন।
সাহিত্যধারা
জসীম উদ্দীন অল্প বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায়, পরিবার এবং বিয়োগান্ত দৃশ্যে, একদম সাবলীল ভাষায় তিনি বিশেষ আলোচিত কবিতা ‘কবর’ লিখেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় এই কবিতাটি প্রবেশিকার বাংলা পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়। ‘কবর’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে এক নিদর্শন হিসেবে আজও আলোচিত। তিনি অসংখ্য গান রচনা করেছেন। বাংলার বিখ্যাত লোক সংগীতের গায়ক আব্বাসউদ্দীন তার সহযোগিতায় কিছু অবিস্মরণীয় লোকগীতি নির্মাণ করেছেন, বিশেষত ভাটিয়ালী ধারার গান।
সৃষ্টিকর্ম
কাব্যগ্রন্থ- রাখালী, নকশী কাঁথার মাঠ, বালুচর, ধানখেত, সোজন বাদিয়ার ঘাট, হাসু, রুপবতি, মাটির কান্না, এক পয়সার বাঁশী, সখিনা, সুচয়নী, ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে, মা যে জননী কান্দে, হলুদ বরণী, জলে লেখন, পদ্মা নদীর দেশে, মাগো জ্বালায়ে রাখিস আলো, কাফনের মিছিল, মহরম, দুমুখো চাঁদ পাহাড়ি।
নাটক- পদ্মাপার, বেদের মেয়ে, মধুমালা, পল্লীবধূ, গ্রামের মেয়ে, ওগো পুস্পধনু, আসমান সিংহ, আত্মকথা, যাদের দেখেছি, ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায়, জীবন কথা, স্মৃতিপট, স্মরণের সরণী বাহি।
জসিম উদ্দীনের একমাত্র উপন্যাস ‘বোবা কাহিনী’। এ ছাড়া তিনি ‘চলে মুসাফির’, ‘হলদে পরির দেশে’, ‘যে দেশে মানুষ বড়’ এবং ‘জার্মানীর শহরে বন্দরে’ নামে ভ্রমণ কাহিনী লিখে গেছেন।
মৃত্যু
১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন বিখ্যাত এই বাঙালি কবি। শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাকে ফরিদপুর জেলার অম্বিকাপুর গ্রামে জসিম উদ্দীনকে তাঁর দাদীর কবরের পাশে দাফন করা হয়। গোবিন্দপুরে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে তার জন্মদিনকে স্মরণ করে ‘জসীম মেলা’ নামে একটি পাক্ষিক উৎসব উৎযাপন করা হয়।