২৪ বিপ্লব রক্ষায় মনস্তাত্বিক অংশীদারিত্ব ও রূপকল্প
গত ২৫ আগস্ট সন্ধ্যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনুসের বক্তৃতা শুনলাম। বক্তব্যে এই মানুষটি আমাকে মোহাবিষ্ট করেছেন। তাঁর চিন্তার সততা, মানবিকতা এবং তারুণ্যের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করার সুগভীর আগ্রহ আমাকে বিমোহিত করেছে। তিনি স্বল্প সময়ে বিপ্লবের আদর্শ ও উদ্দেশ্য, শহিদ ও আহতদের অবদান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ইতিহাস, দায়িত্ব সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন। একই সাথে বক্তব্যের ভেতরে তিনি ছাত্র নেতৃত্বের প্রতি আস্থা, জনগণের প্রতি আস্থা ও সহযোগিতার গুরুত্ব, সরকারের স্থায়ীত্বকাল ও সময়সীমা নিয়ে একটি বার্তা দিয়েছেন। ড. ইউনূস তাঁর বক্তব্যে প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান, স্বল্প সময়ে বিবিধ দাবি নিয়ে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ ও করণীয় প্রশাসনের দায়িত্ব সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। ১৮ আগস্ট “Meet with the Diplomatic Crops in Bangladesh” মাধ্যমে তিনি বিশ্ববাসী তথা বিশ্বনেতৃত্বের নিকট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশের প্রত্যাশা, প্রয়োজনীয়তা, সরকারের অগ্রগতি ইত্যাদি তুলে ধরেছেন।
প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের আগে ফ্রান্সে অবস্থানকালে তিনি বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি এবং সম্ভাব্য নিরাপত্তা শঙ্কা সম্পর্কে উল্লেখ করেছিলেন। ড. ইউনূসের উপদেষ্টারা, ছাত্র নেতৃত্ব (২৭শে আগস্ট লিয়াজোঁ কমিটির সাক্ষাৎকার) বিভিন্ন সময়ে এই সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য, অগ্রগতি ইত্যাদি তুলে ধরার সবিশেষ চেষ্টা করছেন।
কিন্তু অতীব দুঃখ ও ভারাক্রান্ত মনে লক্ষ্য করছি যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আইন শৃঙ্খলার উন্নয়ন, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক লুণ্ঠন, গুম, খুন ইত্যাদি বিষয়ে সহায়তা না করে আমরা বিভিন্ন দাবি নিয়ে সোচ্চার হচ্ছি। এই সরকারকে একটি চাপে রাখার কৌশল বলে মনে হয়েছে সাম্প্রতিক দাবি-দাওয়া নিয়ে ঘটমান আন্দোলনগুলোকে। দেশ এখন বন্যার ক্ষয়ক্ষতিতে নিমজ্জিত। মানুষ যখন পানিবন্দি তখন এরকম আন্দোলনের সূত্রপাত অন্য কিছুরই ইঙ্গিত বহন করে। আমরা যদি, এই আন্দোলনগুলোকে মানবতার নিরিখে বিবেচনা করি, তাহলে এটি প্রতিবিপ্লবের এক একটি রুপান্তর মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমনটি ঘটছে। আমার মত হলো, ছাত্র-জনতা-সৈনিকের অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের গতি ও মাত্রা এতই কঠিন ও গতিশীল ছিল যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, কৃষক, শ্রমিক, প্রবাসী ইত্যাদিরা এই বিপ্লবের গতিবিধি ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। তাই, অনেকেই এই গণ অভ্যুত্থানকে বিপ্লব হিসাবে গ্রহণ করতে এখনও দ্বিধান্বিত। বিপ্লব নিয়ে তাদের অস্পষ্ট ধারণার কারণেই এরকম আন্দোলন বারবার রাজধানীতে ফিরে আসছে। এটিকে সাম্প্রতিক আন্দোলনকারীদের ব্যর্থতা। কোনো ভাবেই ছাত্র জনতা ও ২৪ বিপ্লবের বিপ্লবীদের নয়।
ব্যক্তিগত ও কতিপয় গোষ্ঠীগত আন্দোলনকারীরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের মন ও মস্তিস্কে নীতি, নৈতিকতা ও দায়িত্বের পরিবর্তে পদলেহন, আত্মতুষ্টি এবং চিন্তার দুর্নীতিকে প্রাধান্য দিয়েছে। এই দায় তাদের। আশা করা যায়, অতি দ্রুততার সাথে এইসব পরজীবী শ্রেণীর মানুষেরা ছাত্র-জনতার ২৪ বিপ্লবের উদ্দেশ্য, গতি, আদর্শ ও দর্শনকে গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও বিনির্মাণে আত্মনিয়োগ করবেন।
ছাত্র-জনতা-সৈনিকের বিপ্লবের প্রতি মনস্তাত্বিক গতি জড়তা দূর করা এবং বিপ্লবের রূপকল্প বাস্তবায়নের জন্য আমরা যা করতে পারি-
প্রথমত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নাম পরিবর্তন করে 'বিপ্লবী জাতীয় সরকার (বিজাস)' হিসাবে অভিহিত করা যেতে পারে। এবং সাংবিধানিক জটিলতা ও দায়মুক্তির জন্য পুনরায় ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে নতুনভাবে শপথ নেয়া যায়। কারণ, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ মনোনীত রাষ্ট্রপতির নিকট শপথ নেওয়া সম্পূর্ণ অবৈধ ও ভবিষ্যৎ প্রতিবিপ্লবের ঝুঁকি রাখে।
দ্বিতীয়ত, ২৪ এর আগস্ট বিপ্লবে আহত ও শহিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে হবে। এ সংক্রান্ত দীর্ঘসূত্রিতার জন্য স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সচিব ও অধিদপ্তরের ডিজিদেরকে ওএসডি এবং বিভাগীয় তদন্ত করা যেতে পারে।
তৃতীয়ত, ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংবিধান, শিক্ষা, পুলিশ, বিডিআর হত্যা, শাপলা চত্তরের হত্যা, ৫ আগস্টের ঘটনা, হত্যা ও আহত দুর্নীতি ইত্যাদির ব্যাপারে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে শ্বেতপত্র ও কমিশন গঠন করার পরিপত্র প্রকাশ করতে হবে।
চতুর্থত, উপজেলা, জেলা ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে “‘বিজাস’ সহযোগিতা কমিটি” গঠন করে বিভিন্ন কমিশনকে সহায়তা এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও বিনির্মাণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে।
পঞ্চমত, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে শান্তিশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য অভাব দূর এবং বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে সম্পদে পরিণত করতে শিক্ষা ও প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। ন্যায্য ও সমতাভিত্তিক উন্নয়ন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। তরুণদের অংশগ্রহণ ও মতামতকে অগ্রাধিকার দিয়ে ‘বিজাস' কর্তৃক ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য নতুন রূপকল্প ও কর্মপরিকল্পনা প্রদান করাও জরুরি।
ষষ্টত, ৩০ আগস্টের মধ্যে সর্বস্তরে দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও বিদেশি সম্পদ জবর দখল, চাঁদাবাজি ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ ও ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। এ লক্ষ্যে বিশেষ কমিশন গঠন এবং ওই ডাটা বিবিধ কমিশনে প্রদানের সহজ ব্যবস্থা রাখা দরকার।
সপ্তমত, ‘বিজাস' এর জন্য ছাত্রদের ৬ জনের “লিয়াজোঁ কমিটি” এবং প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন বিষয়ক (Defence and National Integration Development) বিশেষ সহকারীর অফিস, ‘অপারেশন নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জাতীয় সংসদে স্থাপন করে সামগ্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়াদি মনিটরিং করা।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি অতি সংকটময় মুহূর্ত অতিবাহিত করছে। ছাত্র-জনতা -সৈনিকের প্রত্যাশার বিপ্লবকে সফল করা সবার নৈতিক দায়িত্ব। সর্বস্তরে মন মানসিকতার রূপান্তর ছাড়া এটি সম্ভব নয়। এ দেশের প্রতিটি নাগরিককে এ জন্য পরিবর্তিত হতে হবে। দুর্নীতি, বৈষম্য, ঘুষ, অব্যবস্থাপনা, দলবাজি, স্বেচ্ছাচারিতা, চাটুকারীতার জগতে দেশ যেন আর কখনো ফিরে না যায়, সেদিকে নজর রাখতে হবে।
এজন্য স্বেচ্ছাশ্রমের মানসিকতায় সবাইকে উজ্জীবিত হতে হবে। প্রবাসী, দেশের দক্ষ পেশাজীবী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে 'বিজাস' কর্তৃক নিয়োগকৃত হবেন। যদি বিপ্লবের আদর্শে আমরা সবাই রূপান্তরিত ও উজ্জীবিত না হই তবে এই বিপ্লব প্রতিবিপ্লব দ্বারা পরাস্ত/আঘাতপ্রাপ্ত হবে।
তাই ভালবাসা, মানবিকতা, ন্যায্যতা এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে তাদের যথাযথ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। একই সাথে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে সম্পৃক্ত করে সুষম উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা নিশ্চিত করতে হবে। এই প্রত্যাশা হোক বাংলাদেশর আপামর জনগণের।
লেখক
ড. মো. নাসিমুল গনি
তিনি সামরিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী ও লেখক। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অবসর প্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।
ই-মেইল : ghaniboby@yahoo.com