• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী গ্রামীন খেলাধুলা

হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী গ্রামীন খেলাধুলা

প্রতিকী ছবি

ফিচার ডেস্ক

গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী অংশ খেলাধুলা আমাদের সংস্কৃতির অংশ। অঞ্চল ভেদে একই খেলা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। বাঙালি ও বাংলাদেশের শিশু, কিশোর-কিশোরীরা নানা দেশীয় খেলার সঙ্গে পরিচিত। বিশেষ করে দেড় যুগ আগেও গ্রামাঞ্চলে অসংখ দেশীয় খেলা চোখে পড়ত। ছড়া-কবিতার সুরে সুরে এসব খেলা সারাদেশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এখনও কিছু কিছু খেলা গ্রামাঞ্চলে চালু আছে।

তবে তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে এখন শিশু-কিশোরদের শৈশব কাটছে মোবাইল ফোন, ভিডিও গেমস আর কম্পিউটারের সঙ্গে। শহরের শিশুদের মাঠে খেলার প্রবণতা বহুগুণ কমে গেছে। গ্রামাঞ্চলে হাতেগোনা কয়েকটি খেলা চালু থাকলেও ঐহিত্যবাহী অধিকাংশ খেলায় এখন বিলুপ্ত প্রায়।

‘আমরাই বাংলাদেশ’র পাঠকদের জন্য তাই আমাদের এবারের আয়োজনে থাকছে গ্রাম-বাংলার হারিয়ে যাওয়া কয়েকটি খেলার গল্প। যেসব খেলার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের অনেকের শৈশব-কৈশর। 

ইচিং বিচিং

বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের একটি জনপ্রিয় গ্রামীণ খেলা ‘ ইচিং বিচিং’। সাধারণত এই খেলার জন্য শিশু ও কিশোরীরা গ্রাম সংলগ্ন সবুজ মাঠকে বেছে নেয়। উচ্চতা অতিক্রম করা এই খেলার মূল বিষয়।

ইচিং বিচিং খেলার ছড়া:

ইচিং বিচিং চিচিং ছা
প্রজাপতি উড়ে যা যা

নিয়ম: দু'জন খেলোয়াড় পাশাপাশি বসে খেলোয়াড়দের অতিক্রম করার জন্য হাতের আঙুলের ওপর আঙুল রেখে উচ্চতা নির্মাণ করে। প্রথমে পায়ের গোড়ালি মাটিতে রেখে তার ওপর হাতের আঙুল রেখে সর্বোচ্চ উচ্চতা নির্মাণের চেষ্টা করে থাকে। অন্যান্য খেলোয়াড়রা ছড়া পড়তে পড়েত দুর থেকে দৌড়ে এসে উচ্চতা অতিক্রম করার জন্য লাফ দেয়।

এভাবে উচ্চতা অতিক্রম করার পর দ্বিতীয় পর্বে দুজন খেলোয়াড় দুই পা দুদিকে ছড়িয়ে প্রশস্ত আয়তাকার তৈরি করে। অন্য খেলোয়াড়রা লাফ দিয়ে ওই আয়তাকার অতিক্রম করে। এভাবেই এগিয়ে যায়, ইচিং বিচিং খেলা। কালের পরিক্রমায় আজ গ্রাম বাংলায় এই খেলা দেখা যায় না।

ওপেন টু বাইস্কোপ

ওপেন টু বাইস্কোপ বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় একটি গ্রামীণ খেলা। বিশেষ করে স্কুল পড়ুয়া মেয়েরা এই খেলা বেশি খেলতো। এটি একটি সহায়ক খেলা। এই খেলায় ব্যবহৃত ছড়া নিয়ে দেশে একাধিক গানও রচিত হয়েছে। এই খেলায় ব্যবহৃত ছড়া মূলত ব্রিটিশ শাসনের সময়কালকে ইঙ্গিত করে।

ছড়া :
ওপেন টু বাইস্কোপ
নাইন টেন তেইশ কোপ
সুলতানা বিবিয়াানা
সাহেব বাবুর বৈঠকখানা
সাহেব বলেছে যেতে
পান সুপারি খেতে
পানের আগায় মরিচ বাটা
স্প্রিংয়ের চাবি আঁটা
যার নাম রেনুবালা
তাকে দেবো মুক্তার মালা।

কড়ি খেলা

এটি বাংলাদেশের গ্রামীন জনপদের একটি জনপ্রিয় খেলা। কিন্তু কালের বিবর্তনে এই খেলাটি এখন আর চোখে পড়ে না। কড়ি খেলা পাঁচ গুটি খেলার মতই আরেকটি খেলা। এই খেলায় কড়ি হিসেবে খেজুরের বিচি ব্যবহার করা হতো।

কড়ি খেলার ছড়া-
খুশুর খুশুর দুর্গা মাসুর
তিন তালিয়া মার কেলিয়া
কুমড়ার চাক ধাপ্পা দিয়া
হাতের কড়ি হাতে থাক

কানামাছি

দেশে একটা সময় কানামাছি খেলার জনপ্রিয়তা ছিল ব্যাপক। বিকেল বেলা কিংবা স্কুলে শিশু কিশোর-কিশোরীরা দলবেঁধে কানামাছি খেলা করতো। এটি একটি চমৎকার খেলা।

কানামাছি খেলার ছড়া-

কানামাছি ভোঁ ভোঁ
যারে পাবি তারে ছো

এ খেলায় কাপড় দিয়ে একজনের চোখ বেঁধে দেয়া হয়। যার চোখ বাঁধা থাকে সে অন্যজনকে ধরার চেষ্টা করে। যদি চোখ বাধা ব্যক্তি অন্যকাউকে ধরে ফেলে, তাহলে ধৃত ব্যক্তির চোখ বেঁধে আবারও সবাই ছড়া কাটতে শুরু করে।

লাঠি খেলা

লাঠি খেলা আবহমান গ্রাম-বাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী খেলা। এই খেলাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি রাজ্যে বিশেষ ভাবে শেখানো হয়। 'লাঠি খেলা' অনুশীলনকারীকে 'লাঠিয়াল' বলা হয়। গ্রাম-বাংলার লাঠিয়ালরা একসময় এই খেলা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো।

প্রায় হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী এই খেলাটি এখনও টিকে আছে। সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, জয়পুরহাট, পঞ্চগড় ও নড়াইল জেলায় এখনও লাঠিখেলার প্রচলন রয়েছে। বিভিন্ন উৎসবে এসব এলাকায় এখনও লাঠিখেলার আয়োজন করা হয়।

কাবাডি

বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি। এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় খেলা এই ‘কাবাডি’। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কাবাডি খেলা হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর-যুবকরা এখনও কাবাডি খেলায় মেতে উঠেন।

কুতকুত

গ্রামীন কিশোরী ও তরুণীদের একটি জনপ্রিয় খেলার নাম ‘কুতকুত’। এই খেলাকে অনেক এলাকায় ‘কিতকিত’ বলা হয়। বাড়ির উঠান অথবা অন্য কোনও শুষ্ক ও সমতল জায়গায় এই খেলা করা হয়। কুতকুত খেলতে মাটির পাতিল বা হাঁড়ির ভাঙা টুকরো (খাঁপড়া) ব্যবহৃত হয়।

কুতকুত খেলার ছড়া-

লাইলি লুইলি বাঁশের চোঙ
বাঁশ কাটলে টাকা থোঙ
এত টাকা নেবো না
লাইলির বিয়ে দিব না
লাইলির আম্মা কাঁন্দে
গলায় রশি বান্ধে

গোল্লাছুট

বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ‘গোল্লাছুট’। গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে এই খেলা দেশের শহরাঞ্চলেও পরিচিত। ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, খুলনা, পাবনায় এই খেলার প্রচলন সবচেয়ে বেশি।

বউচি

বউচি বাংলাদেশের একটি গ্রামীণ ও ঐতিহ্যবাহী খেলা। এই খেলায় দুটি দলের প্রয়োজন হয়। প্রত্যেক দলে ৮ থেকে ১০ জন করে খেলোয়াড় থাকে। খোলা মাঠ অথবা বাড়ির উঠানে এই খেলা করা যায়। খেলার শুরুতে ২০-২৫ ফুট দূরত্বে মাটিতে দাগ কেটে দুটি ঘর তৈরি করতে হয়।

দুই দলের মধ্যে যারা প্রথমে খেলার সুযোগ পায় তাদের মধ্যে থেকে একজনকে বউ বা বুড়ি নির্বাচন করা হয়। দুটি ঘরের মধ্যে একটি ঘর হবে বড়, সেখানে এক পক্ষের বউ বাদে সব খেলোয়াড়া থাকবে। আর ছোট ঘরে দাঁড়াবে বউ। ছোট ঘরটিকে বউঘর বা বুড়িঘর বলে। বউয়ের বিচক্ষণতার ওপর খেলার জয় পরাজয় নির্ভর করে। খেলায় বউঘর থেকে বউকে ছুটে আসতে হবে বড় ঘরে। কিন্তু বড় ঘরে ছুটে আসার সময় বিপক্ষ দলের কেউ যদি বউকে স্পর্শ করে দেয়, তাহলে বউপক্ষ হেরে যাবে। এভাবেই খেলাটি শেষ হয়।

টোপাভাতি

টোপাভাতি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেলা। সাধারনত শিশুরা এই খেলা খেলে থাকে। টোপা মানে হাঁড়ি বা রান্না করার বাসন এবং ভাতি হলো ভাত রান্না করা। এজন্য রান্না করার এ খেলাকে টোপাভাতি বলা হয়।

ডাংগুলি

বাংলাদেশ ও উত্তর ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় গ্রামীন খেলা ডাংগুলি। সাধারণত কিশোর বয়সী ছেলেরা এই খেলা খেলে থাকে। এই খেলাটি এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

খেলার উপকরণ দু'টি- একটি দেড় থেকে দুই ফুট লম্বা লাঠি (ডাং বা ডান্ডা), অপরটি গুলি। যা গোলা নামেও পরিচিত। আসলে প্রায় দুই ইঞ্চি লম্বা আরেকটি ছোট লাঠির নামই গুলি।

ডাংগুলি বাংলার সর্বাঞ্চলীয় একটি জনপ্রিয় খেলা। এই খেলাটি এখন আর তেমন দেখা যায় না।

দাড়িয়াবান্ধা

দাড়িয়াবান্ধা বাংলাদেশের গ্রামীন খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশের সব এলাকাতেই এই খেলাটির প্রচলন ছিল। এ খেলার মাঠটি ৫০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট প্রস্থ। এই খেলার দুটি দলে মোট ৬ জন করে খেলোয়াড় থাকে।

নুনতা খেলা

নুনতা বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জের শিশু/কিশোররা এই খেলা খেলে থাকে। এই খেলা সাধারনত দলবেধে খেলতে হয়। দল যত ভারী হয় খেলা তত মজার হয়। নুনতা খেলায় বৃত্তাকার একটি ঘরের মালিক থাকেন একজন, তাকে অন্যদের দৌড়ে গিয়ে ধরতে হয়।

এই খেলায় প্রথমে মাটিতে দাগ কেটে বৃত্তাকার ঘর বানানো হয়। এরপর একজনকে “নুনতা” নির্বাচন করা হয়।

নুনতা খেলার ছড়া-

নুনতা বলোরে
এক হলোরে
নুনতা বলোরে
দুই হলোরে....(এভাবে সাত পর্যন্ত)
...আমার ঘরে কে?
-আমি রে।
কি খাস?
-লবন খাই।
লবনের সের কত?
-এইটা
লবণের দাম দিবি কবে?
-লাল শুক্কুরবারে (শুক্রবার)।
কয় ভাই? কয় বোন?
-পাঁচ ভাই, পাচঁ বোন।
একটা বোন দিয়ে যা..
-ছঁতে পারলে নিয়ে যা।

ফুল টোকা

ফুল টোকা বাংলাদেশের গ্রামীন শিশু কিশোরদের অন্যতম প্রিয় একটি খেলা। বাড়ির আঙ্গিনায় কিংবা স্কুলের মাঠে মেয়েরা এই খেলা করে থাকে।

ফুল টোকা খেলার ছড়া-

সাইকেল বাজে ক্রিং ক্রিং
বাবুর দোকানে
রাজার বেটির বিয়ে হইছে পাক্কা দালানে
মা দেবে খোঁপা বান্ধে
বাবা দিবে বিয়ে
ফুলের আগায় কড়ি
দশমনকা ভরি

মোরগ লড়াই

মোরগ লড়াই বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আয়োজন করা হয়। এটি সাধারনত ছেলেদের খেলা। গ্রামাঞ্চলের ছেলেদের কাছে এই খেলাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়।

পানিঝুপ্পা

গ্রাম বাংলায় পানি ঝুপ্পা বা ব্যাঙ লাফানো খেলা সাধারনত ছেলেরাই খেলে থাকে। পানিতে না নেমেই এই খেলাটি খেলা যায়। এটি খেলতে দরকার শান-পুকুর বা মরা নদী বা খাল-বিল। পাতলা চ্যাপ্টা মাটির টুকরা, ভাঙা হাড়ির চাড়া বা খোলামকুচি ডাঙা থেকে থেকে হাতের কৌশলে পানির ওপর ছুঁড়ে মারা হয়। চাড়াটি ব্যাঙের মতো লাফাতে লাফাতে গিয়ে এক পর্যায়ে পানিতে ডুবে যায়। একসঙ্গে একই খেলাটি করলে অনেক আনন্দ পাওয়া যায়।

গোলাপ-টগর

গোলাপ-টগর কোথাও ফুলটোক্কা, বউরাণী আবার কোথাও টুকাটুকি নামে পরিচিত। অল্পবয়সি ছেলে মেয়েরা সমান সংখ্যক সদস্য নিয়ে দুই দলে ভাগ হয়ে এই খেলা করে থাকে। দুই দলের দুইজন প্রধানকে রাজা বলা হয়। খেলার শুরুতে রাজা ফুল ও ফলের নামে নিজ দলের সদস্যদের নাম ঠিক করে দেয়। এরপর সে বিপক্ষ দলের যেকোন একজনের চোখ হাত দিয়ে বন্ধ করে, ‘আয়রে আমার গোলাপ ফুল, বা আয়রে আমার টগর ফুল’ ইত্যাদি নামে ডাক দেয়।

এসময় চুপিসারে এসে চোখবন্ধ থাকা খেলোয়াড়ের কপালে টোকা দিয়ে নিজ অবস্থানে ফিরে যায় রাজার দলের খেলোয়াড়। এর পর চোখ বন্ধ থাকা খেলোয়াড় টোকা দেয়া ব্যক্তিকে শনাক্ত করার চেষ্টা করে। এভাবেই খেলাটি চলতে থাকে।

 

টাইমস/এসএন

১৮ জুলাই ২০২১, ০৭:৪২পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।