• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
পর্ব- ১

নবান্নে আবহমান বাংলার শীতের পিঠাপুলি

নবান্নে আবহমান বাংলার শীতের পিঠাপুলি

ছবি- সংগৃহিত

ফিচার ডেস্ক

অগ্রহায়ণ পেরিয়ে পৌষের উঠোনে বাংলাদেশ। নতুন ধানের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামের বাতাসে। বছরের এই সময়টা নতুন ধানের নতুন চালের গুড়ো দিয়ে পিঠাপুলি বানানোর ধুম পড়ে যায় সারাদেশে। এলাকা ভেদে পিঠাপুলির নাম, স্বাদ ও তৈরির ধরণ ভিন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু তারপরও নবান্নের আহ্বান সারাদেশেই যেন একই রকম।

আবহমান কাল থেকে অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি থেকে নতুন ধান কাঁটা শুরু হয়। এরপর শুরু হয় নবান্ন উৎসব। কৃষকের ঘরে যখন নতুন ধান ওঠে সেই ধান ঢেকিতে ভেঙ্গে তৈরি করা হয় নানা রকম পিঠা। কৃষকের ঘরে থাকে নতুন চালের ভাত। আর এসব মিলেই নবান্ন উৎসবের উপলক্ষ ছড়িয়ে যায় গ্রাম থেকে শহরে।

এ ছাড়া শীতকালের আবার খেঁজুর গাছের রস জ্বাল দিয়ে নতুন গুড়ও তৈরি হয়। বর্তমানে খেঁজুর গুড়ের বাণিজ্যিকীকরণে তা গ্রাম কিংবা শহর, সবখানেই পাওয়া যায়। আর নতুন গুড় ও নতুন চালের গুড়ো দিয়ে বাঙালি বধু, তনয়া, জননীরা বাড়িতেই বানিয়ে ফেলে নানা পদের পিঠাপুরি।

রাজধানী ঢাকা কিংবা অন্যান্য বড় শহরের ফুটপাতেও এখন পিঠার দোকান দেখা যায়। ফুটপাতের টং দোকান কিংবা ভ্রাম্যমাণ পিঠার দোকানও শহরে চোখে পড়ে।

প্রিয় পাঠক, হয়তো এতক্ষনে বুঝতে পেরেছেন আজকের পর্বে গ্রাম বাংলার শতবছরের ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলি নিয়ে কিছু তথ্য দিতে চলেছি। হ্যা, ঠিক তাই। আবহমান বাংলার সুস্বাদু ও ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলি তৈরির রেসিপি নিয়ে আমাদের এই আয়োজন। চলুন দেখে নেয়া যাক প্রথম পর্বে কি কি থাকছে।

ভাপা পিঠা : গ্রাম বাংলার অত্যন্ত পরিচিত একটি পিঠার নাম ভাপা পিঠা। সেদ্ধ ও আতপ চালের গুঁড়া দিয়ে এই পিঠা বানানো হয়। এই পিঠা তৈরিতে চালের গুঁড়া, গুড়, নারকেল, লবণ আর পানির প্রয়োজন হয়। কয়েকরকম ভাপা পিঠা রয়েছে। যেমন- খেঁজুর রসের ভাপা পিঠা, শাহী ভাপা পিঠা।

যা প্রয়োজন: চালের গুঁড়া ৫০০ গ্রাম, গুড় এক কাপ, নারকেল কুরানো বড় ১ কাপ, লবণ আধা চা চামচ, পানি সামান্য। পিঠার জন্য ছোট দুটি বাটি ও দুই টুকরো পাতলা কাপড়। শাহী ভাপা পিঠা তৈরিতে কিসমিস, বাদাম ও দুধ প্রয়োজন হয়। আর খেঁজুর রসের ভাপা পিঠা তৈরিতে পানির পরিবর্তে খেঁজুর রসের ভাপে পিঠা ভাপ দেয়া হয়।

প্রস্তুত প্রনালি: চালের গুড়া একটু পানি দিয়ে ঝুরজুরা করে মাখিয়ে নিয়ে বাঁশের চালুনিতে করে চেলে নিতে হবে। এরপর বাটিতে অল্প চালের গুঁড়া দিয়ে তার মাঝখানে গর্ত করে গুড় ও নারকেল দিয়ে ওপরে চালের গুঁড়া দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এবার পাতলা কাপড় ভিজিয়ে পিঠা ঢেকে দিয়ে বাটির নিচ পর্যন্ত কাপড় ধরে বাটিটি উল্টে দিয়ে ফুটন্ত পানির ওপর ছিদ্র করা ঢাকনার ওপর বসিয়ে বাটিটি উঠিয়ে পিঠার কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। পাঁচ-ছয় মিনিট পর তৈরি হয়ে যাবে ভাপা পিঠা।

খোলা চিতুই : চালের গুঁড়া পানিতে মিশিয়ে পাতলা গোলা তৈরি করে নিতে হয়। এই পিঠা মিষ্টি ও ঝাল দুই ধরণের স্বাদে খাওয়া যায়। চিতুই পিঠার খোলায় সামান্য তেল মাখিয়ে খোলা খুব গরম করে দুই টেবিল চামচ চালের গুঁড়ার পাতলা গোলা দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। ঢাকনার চারপাশে পানি ছিটিয়ে ৩-৪ মিনিট পর পিঠা তুলে গুড়ের সিরায় ভেজাতে হবে।

দুধ চিতুই : এই পিঠা আমাদের দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়। চিতুই পিঠা ও দুধ চিতুই একই জিনিস। দুধ চিতুই কেবল দুধের সিরায় ভেজাতে হয়। এটি তৈরিতে চালের গুঁড়া ৪ কাপ, দুধ ১ লিটার, গুড় ২ কাপ, কোরানো নারকেল আধা কাপ প্রয়োজন হয়।

প্রস্তুত প্রণালি: দুধ জাল দিয়ে ঘন করে নিতে হবে। এরপর আলাদা গুড়ের সিরা তৈরি করে সেটি ঠাণ্ডা করে রাখতে হবে। এবার হালকা গরম পানিতে চালের গুঁড়া গুলিয়ে নিয়ে পাতলা গোলা তৈরি করে মাটির খোলায় কাপে করে গোলা দিয়ে পিঠা তৈরি করতে হবে। গুড়ের রসে ভেজাতে হবে চিতুই। পিঠা ঠাণ্ডা হলে তার ওপর ঠাণ্ডা দুধ ঢেলে দিয়ে নারকেল ছড়িয়ে দিলে তৈরি হয়ে যাবে দুধ চিতুই।

রস চিতুই : এটিও দুধ চিতুই বা চিতুই পিঠার মতোই তৈরি করতে হয়। প্রথমে দুধ জাল দিয়ে ঘন করে আলাদা করে গুড়ের সিরা তৈরি করে রাখতে হবে। এবার হালকা গরম পানিতে গুঁড়া গুলে পাতলা গোলা তৈরি করতে হবে। এবার মাটির খোলায় গোলা ঢেলে পিঠা তৈরি করতে হবে। পিঠা ঠাণ্ডা হলে জ্বাল দেওয়া রসে ভিজিয়ে রাখতে হবে সারারাত! এটি গ্রাম বাংলার কৃষক পরিবারগুলোতে সবচেয়ে বেশি খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। খেঁজুরের রসে ভেজানো চিতুই পিঠা বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য।

কুলি পিঠা : নারকেল, তিল, চাল ভাজা ও গুড়ের মিশ্রণে তৈরি হয় কুলি পিঠা। এটি জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থানীয়দের অন্যতম। এই পিঠা তৈরিতে আতপ চালের গুঁড়া ২ কাপ, খেজুরের গুড় পরিমাণমতো, কোরানো নারকেল ১ কাপ প্রয়োজন হয়।

প্রস্তুত প্রনালি: প্রথমে আতপ চালের গুঁড়া হালকা ভেজে পরিমাণমতো পানি দিয়ে কাই করে নিতে হবে। কড়াইতে গুড় ও নারকেল একসঙ্গে চুলায় দিয়ে জ্বাল দিতে হবে। মিশ্রণটি শুকিয়ে আঠালো ভাব হলে তা দিয়ে খামির বানাতে হবে। এবার চালের গুঁড়ার খামির থেকে গোল গোল আটার দলা পাতলা করে বেলে নিতে হবে। বেলে নেয়া পাতলা আটার মাঝখানে পুর বা নারকেলের মন্ড দিয়ে আটার চারপাশ থেকে গুছিয়ে অর্ধচন্দ্রাকার আকৃতি দিয়ে মুখটি বন্ধ করে দিতে হবে। এভাবে সব পুলি পিঠা বানিয়ে ভাপে সিদ্ধ করতে হবে।

ভাজা কুলি পিঠা : ভাপা কুলি পিঠা পানির ভাপে না দিয়ে হালকা তেলের কড়াইয়ে ভেজে নিলেই ভাজা কুলি পিঠা হয়ে যায়।

ঝাল কুলি : এই কুলি পিঠা তৈরির সময় নারকেল, তিল, গুড় দিয়ে পুর বা মিষ্টি বানাতে হয়। এই পুর আটা দিয়ে তৈরি পাতলা আবরনের ভেতরে থাকে। কিন্তু ঝাল কুলি পিঠার মন্ড বা পুর তৈরি করতে হয় সিঙ্গারার ভেতরের উপাদানের মতো। আপনি চাইলে, মাংস, সবজি, ডালসহ যেকোনো উপাদান যোগ করতে পারেন। তবে ঝাল কুলি পিঠা ভাপে সেদ্ধ করা যাবে না। এটি ভেজে নিতে হবে।

দুধপুলি : এই পিঠার নাম শুনেনি এমন মানুষ বাংলাদেশে পাওয়া ভার। অত্যন্ত সুস্বাদু ও জনপ্রিয় একটি পিঠা দুধপুলি। এটি তৈরিতে প্রয়োজন হয় চালের গুড়া ২ কাপ, নারকেল ১ ভাগের ৪ কাপ, দুধ ২ কাপ, চিনি ১ কাপ, এলাচ কয়েকটি, পানি ২ কাপ।

প্রস্তুত প্রনালি: দুধপুলি তৈরির জন্য পানি ও চালের গুড়া দিয়ে শক্ত ডো তৈরি করে নিতে হবে। এরপর ছোট ছোট রুটির আকারে বেলে নিতে হবে। এবার রুটির ভেতরে নারকেল দিয়ে ছোট পুলি তৈরি করে চুলায় দুধ জ্বাল দিয়ে তাতে চিনি ও এলাচ সহ পুলি দিয়ে তুলে নামিয়ে নিতে হবে।

ক্ষীর পাটি সাপটা : এই পিঠা দেশের সব অঞ্চলে পাওয়া যায় না। তবে ক্ষীর পাটি সাপটার স্বাদ নিতে চায় না এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। এই পিঠা তৈরিতে প্রয়োজন ক্ষীর- ২৫০ গ্রাম, চালের গুড়া- ১ কেজি, গুড়- ২৫০ গ্রাম, ময়দা- ১/৪ কাপ এবং গুড় ভেঙ্গে ১ কাপ পানিতে গুলিয়ে নিতে হবে।

প্রস্তুত প্রনালি: চালের গুঁড়ো, ময়দা ও গুড় দিয়ে গোলা করতে হবে। কড়াইয়ে সামান্য তেল মাখিয়ে নিতে হবে। আধা কাপ গোলা কড়াইয়ে দিয়ে কড়াই ঘুরিয়ে গোলা ছড়িয়ে নিতে হবে। পিঠায় উপরের দিক শুকিয়ে গেলে এবং রুটির কিনারা কড়াই থেকে আলাদা হলে ১ টেবিল চামচ ক্ষীর পাশে রেখে রুটিটা মুড়িয়ে নিতে হবে।

 

চোখ রাখুন পরবর্তি পর্বে-

২১ ডিসেম্বর ২০২২, ০৫:২২পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।