• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বর্গীয় ফল ডুমুর, পুষ্টিগুণে ভরপুর

স্বর্গীয় ফল ডুমুর, পুষ্টিগুণে ভরপুর

প্রতিকী ছবি

ফিচার ডেস্ক

পবিত্র কুরআনে একটি সুরা আছে, যার নাম ‘ত্বীন’। ‘ত্বীন’ মূলত একটি ফলের নাম। কিন্তু আপনারা কী জানেন, ত্বীন ফল আসলে কী? ত্বীন ফল আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মেও ত্বীন ফলের কথা উল্লেখ রয়েছে। এই ত্বীন ফল মূলত ‘ডুমুর’। যা আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে। হিন্দু বা সনাতনী ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থে এই ফলের নাম ‘অশ্বত্থ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

মুসলিম গবেষকরা বলছেন, ডুমুর বা ত্বীন ফলের গুণাগুণ এতটাই যে, আল্লাহ তায়ালা এই ফলের নামেই একটি সূরা পবিত্র কুরআনে সন্নিবেশিত করেছেন। বিভিন্ন তাফসিরগ্রন্থ ও হাদিসের বর্ণনায় ত্বীন বা ডুমুরকে জান্নাতি বা স্বর্গীয় ফল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া ত্বীন বা ডুমুর ফল নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানীরাও একের পর এক গবেষণা করেছেন। এই ফলের গুণাগুণ সম্পর্কে জানার পর গবেষকরা রীতিমত অবাক হয়েছেন। যে কারণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এখন ডুমুর বা ত্বীন ফলের কদর বেড়েছে। শুরু হয়েছে ডুমুরের বাণিজ্যিক উৎপাদন।

‘আমরাই বাংলাদেশ’র পাঠকদের জন্য এই পর্বে ডুমুরের বিভিন্ন গুণাগুণ ও পুষ্টি বিষয়ে আমরা তথ্য দেয়ার চেষ্টা করেছি। চলুন দেখে নেয়া যাক, কি আছে ডুমুরে-

নাম পরিচয়

এটি আমাদের দেশে ডুমুর নামে পরিচিত। আরব দেশগুলোতে এই ফলকে ‘ত্বীন’ ফল বলা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম-Ficus। মোরাসিয়া গ্রোত্রভূক্ত ৮৫০টিরও অধিক কাঠজাতীয় গাছের একটি প্রজাতিবিশেষ। এটি এক প্রকারের গুল্ম বা লতা জাতীয় গাছের ফল।

এটি বেশ নরম ও মিষ্টি স্বাদের। পাতলা আবরণে আচ্ছাদিত ডুমুরের ভেতরে ছোট ছোট বীজ থাকে। এগুলো শুকিয়ে গুঁড়া করে খাওয়া যায়। এছাড়া পাকা ডুমুরও খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। আবার অনেক এলাকায় কাঁচা ডুমুর তরকারি বা ভাজি হিসেবেও খাওয়া হয়।

ডুমুরের প্রজাতি

ডুমুর কয়েক প্রজাতির হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশে সচরাচর যে ডুমুর পাওয়া যায়, তা আকারে ছোট ও খাওয়ার অনুপযুক্ত। আমাদের দেশের বন-জঙ্গলে যে ডুমুর পাওয়া যায়, তাকে ‘কাক ডুমুর’ বলে। কাক ডুমুর তরকারি হিসেবে খাওয়া হয়।

তবে মধ্যপ্রাচ্য বা আরব দেশগুলোতে যে ডুমুর পাওয়া যায়, তা আকারে বড় ও খাওয়ার উপযোগি। একে আরবে আঞ্জির (হিন্দি, উর্দু, ফারসি ও মারাঠি ভাষা) বলা হয়।

এছাড়া ডুমুরের আরেক প্রজাতির নাম জগডুমুর বা যজ্ঞডুমুর। যার বৈজ্ঞানিক নাম Ficus racemosa, এই ডুমুর মূলত তরকারি হিসেবে বেশি খাওয়া হয়।

অপরদিকে অশ্বত্থ বা পিপল নামেও ডুমুরের আরেকটি প্রজাতি রয়েছে। যার বৈজ্ঞানিক নাম Ficus religiosa, এটি বটগোত্রীয় বৃক্ষে জন্মে। হিন্দু ধর্ম বা সনাতনী ধর্মে অশ্বত্থ গাছ ও ফলের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।

খাদ্য ও পুষ্টি গবেষকরা যা বলছেন

আধুনিক বিজ্ঞানের এই যুগে ত্বীন বা ডুমুর নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। এখনো অধিকতর গবেষণা চলছে। অধিকাংশ খাদ্য ও পুষ্টি গবেষকরা জানিয়েছেন, ডুমুরে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, ভিটামিন বি রয়েছে। এছাড়া ম্যাগনেসিয়াম, জিংক, কপার, ম্যাঙ্গানিজ ও আয়রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান রয়েছে ডুমুরে।

কেন খাবেন ডুমুর

পুরুষত্ব ও নারীর যৌন স্বাস্থ্য রক্ষা : ডুমুরে রয়েছে প্রাকৃতিক আফ্রোডিসিয়াক। যা নারী ও পুরুষের যৌন স্বাস্থ্যের জন্য টনিক হিসেবে কাজ করে। প্রাচীন গ্রীকরা ডুমুরকে পবিত্র ফল হিসেবে মনে করতেন। গ্রীকদের ধারণা, ডুমুর যৌন উর্বরতা বৃদ্ধি করে। আধুনিক বিজ্ঞানেও গ্রীকদের সেই ধারণা প্রমাণ হয়েছে। কারণ ডুমুরে থাকা খনিজ উপাদান যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক কার্যকরি।

স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে : ডুমুরে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। এছাড়া এতে রয়েছে উচ্চ মাত্রার আঁশ। যা নারীদের মেনোপোসাল স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ডুমুর : গবেষকরা বলছেন, ডুমুরের পাতায় পর্যাপ্ত পলিফেনন রয়েছে। এই পলিফেনন ডায়াবেটিসের লক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া ডুমুর শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন ও ইনসুলিনের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। কাজেই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডুমুর হতে পারে দারুণ এক ভেষজ ওষুধ। ডুমুরে রয়েছে উচ্চ মাত্রার পটাসিয়াম, যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ডুমুরে রয়েছে ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড, যা ডায়াবেটিস টাইপ-২ আক্রান্তদের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ : উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে পটাসিয়াম কার্যকরি ভূমিকা পালন করে। আর এই পটাসিয়ামের প্রাকৃতিক উৎসগুলোর মধ্যে ডুমুর সবার শীর্ষে।

হৃদযন্ত্রের সুরক্ষায় ডুমুর : জাপানের একদল গবেষক বলছেন, ডুমুরে রয়েছে পটাসিয়াম ও সোডিয়ামের মিশ্রণ। যা আমাদের হৃদযন্ত্র ও কিডনির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খুবই কার্যকরি। বিশেষ করে মানব দেহের ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে গেলে হৃদযন্ত্র দূর্বল ও ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে। কিন্তু ডুমুরে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে থাকা ফ্রি র‌্যাডিক্যাল নির্মূল করে। যে কারণে আমাদের হৃদযন্ত্র ভালো থাকে।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে : ডুমুর প্রাকৃতিক আঁশ সমৃদ্ধ একটি ফল। আর এই প্রাকৃতিক আঁশ আমাদের হজমশক্তি বা পরিপাক ক্রিয়া মজবুত করে। হজম বা পরিপাক স্বাভাবিক হলে মল নরম হয়। ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়।

হাড় মজবুত রাখে : হাড়ের সুরক্ষায় ক্যালসিয়ামের বিকল্প নেই। কিন্তু আপনি জানেন কী, ডুমুরে রয়েছে উচ্চ মাত্রায় প্রাকৃতিক ক্যালসিয়াম। যা হাড় মজবুতকরণ ও হাড়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খুবই কার্যকরি। গবেষকরা বলছেন, ক্যালসিয়ামের প্রাকৃতিক উৎসগুলোর মধ্যে ডুমুর সবার শীর্ষে।

ত্বকের যত্নে ডুমুর : একজিমা, ভ্যাটিলিগো, সেরিয়াসিসসহ নানা ধরণের চর্মরোগের চিকিৎসায় ডুমুর বেশ সফল। ত্বকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চর্মরোগ নিরাময়ে ভেষজ গুণে ভরপুর ডুমুরের নানাবিধ ব্যবহার প্রচলিত রয়েছে। গবেষকরা বলছেন, নিয়মিত ডুমুর খেলে চেহারার উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায় এবং লাবণ্যময় হয়ে উঠে।

চুল বাঁচাতে ডুমুর : বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের চুল পড়ে যায় বা চুল পাতলা হয়ে যায়। হরমনজনিত সমস্যার কারণেও অনেকের মাথার চুল পড়ে যায়। কিন্তু আপনি জানেন কী, ডুমুরে রয়েছে কপার ও জিংকের মতো খনিজ উপাদান। যা আপনার চুল পড়া রোধ করবে এবং চুলের শক্তি ফিরিয়ে আনবে।

ওজন কমাতে সহায়তা করে : আপনি যদি বাড়তি ওজন ঝরিয়ে ফেলতে চান, তাহলে আপনার জন্যই ডুমুর। কারণ এই ফলে রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক আঁশ। আর এই আঁশ আমাদের শরীরের মেটাবলিজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। যা বাড়তি মেদ ঝরিয়ে দেয়। ফলে ওজন কমতে শুরু করে।

পরামর্শ : একদল মার্কিন গবেষক জানিয়েছেন, শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত ক্যালরি কমাতে শুকনো ডুমুর খুবই কার্যকরি। তবে ডুমুর অল্প পরিমাণে খেতে হবে। পরিমিত ডুমুর যেমন ওজন কমাতে সহায়তা করে, তেমনি অতিরিক্ত ডুমুর খেলে ওজন বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া যারা এলার্জি ও রক্ত স্বল্পতাজনিত সমস্যায় ভুগছেন, তারা ডুমুর খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।

 

এবি/এসএন

৩১ জুলাই ২০২১, ০৮:১০পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।