• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাসায়নিক সার ব্যবহারে যেভাবে বাড়ছে পরিবেশের ঝুঁকি

রাসায়নিক সার ব্যবহারে যেভাবে বাড়ছে পরিবেশের ঝুঁকি

প্রতিকী ছবি

ফিচার ডেস্ক

ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জোর প্রচেষ্টা চলছে। শিল্প বিপ্লবের পর সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধির যে গবেষণা এগিয়ে নিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা, তা অনেকটাই কৃত্রিম সার ও কীটনাশক নির্ভর পরিকল্পনা। কম মাটি ও অল্প বীজ ব্যবহার করে কিভাবে বেশি ফলন পাওয়া যায় তা নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। এক্ষেত্রে সফলতাও এসেছে। বেড়েছে খাদ্য উৎপাদন।

তবে আধুনিক প্রযুক্তিতে কৃত্রিম সার প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদিন ফল-ফসল প্রাণীদেহের জন্য হুমকিও বটে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে খাদ্য এখন স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। এ নিয়েও পুষ্টিগবেষক ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা বিচলিত।

কৃত্রিম সার প্রাণীদেহেই কেবল বিরূপ প্রভাব ফেলছে তা নয়, বরং এটি পরিবেশ ও প্রতিবেশেরও ব্যাপক ক্ষতি করছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনেও কৃত্রিম সারের প্রভাব রয়েছে। জীববৈচিত্র ক্রমেই ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির প্রাকৃতিক চিরচেনা রূপ।

প্রিয় পাঠক, চলুন দেখে নেয়া যাক কৃত্রিম সার ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

কৃত্রিম সার কি?

এই সার মাটিতে বা উদ্ভিদের টিস্যুতে প্রয়োগ করা হয়, যা গাছের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় এক বা একাধিক উদ্ভিদের পুষ্টি সরবরাহ করতে বা উদ্ভিদের পুষ্টির ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে। নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাসিয়ামের অন্তত ৫% ধারণ করে একটি কৃত্রিম সার তৈরি করা হয়। শিল্পগতভাবে তৈরি সারকে কখনও কখনও ‘খনিজ’ সারও বলা হয়ে থাকে। যেমন- চুন, জিপসাম, পটাসিয়াম ইত্যাদি।

সার কত রকমের?

মূলত অজৈব ও জৈব হিসেবে পরিচিত সার। জৈব সার প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান থেকে তৈরি করা হয়। অজৈব সার হলো এমন একটি সার, যাতে জৈব সারের সকল উপাদান কৃত্রিম উপায়ে বা কৃত্রিম উৎস থেকে সংমিশ্রণ করা হয়। অজৈব সারের অপর নাম রাসায়নিক সার।

রাসায়নিক সার তৈরি সহজ, এতে কম শ্রম প্রয়োজন হয়। এই সার সহজেই কৃষকের কাছে পৌছানো যায়। জৈব সারের তুলনায় রাসায়নিক সারে ফসলের উপযোগী উপাদানের অনুপাত ঠিক রাখা যায়। উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম রাসায়নিক সারে আনুপাতিক হারে থাকে। আবার পুষ্টির প্রকারের ভিত্তিতে রাসায়নিক সারে দু-একটি ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টও থাকে।

রাসায়নিক সারের প্রভাব

রাসায়নিক সার ফসলের উৎপাদন বাড়িয়েছে ঠিকই। কিন্তু এই সার পরিবেশ ও খাদ্যমান ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসল মানবদেহের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। এ ছাড়া রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটি, পানি ও বায়ু দূষণ বাড়ছে। কমে যাচ্ছে আদর্শ মাটির গুণাগুণ। চাষাবাদে পড়ছে তার নেতিবাচক প্রভাব। উপকারি পোকামাকড় মারা যাওয়ায় পরিবেশে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে।

মাটি দূষণ

ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এখন দৃশ্যমান। মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। মাটি, পানি, বায়ু দূষণ বাড়ছে। কমে যাচ্ছে মাটির গুণাগুণ। উপকারি পোকামাকড় মারা যাওয়ায় পরিবেশে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। মাটির ক্ষয়, মাটিতে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি, মাটির উপরিভাগের ওপরে ও নিচে বিদ্যমান বিভিন্ন উপকারী জীবের বিষাক্ততা, উৎপাদন থেকে আয় কমে যাচ্ছে।

এই কৃত্রিম সারগুলি শুধুমাত্র আমাদের পরিবেশের জন্যই বিপজ্জনক নয়, মানুষ, প্রাণী এবং জীবাণু জীবের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। সময় এসেছে সবাই অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের কুফল বুঝতে এবং তা কমানোর উদ্যোগ নেয়া।

বায়ু দূষণের ওপর রাসায়নিক সারের প্রভাব

ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য রাসায়নিক সারের উচ্চ প্রয়োগের হার অসংখ্য ক্ষতিকারক গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি করছে। প্রতিরক্ষামূলক ওজোন স্তরকে ক্ষয় করছে। তাই মানুষকে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে আনছে। নৃতাত্ত্বিক N2O নির্গমনের ৬০% জন্য কৃষি দায়ী, এবং কৃষি মৃত্তিকা প্রধান উৎস। নাইট্রোজেন সার তৈরির সময় CO2, CH4 এবং N2O-এর মতো গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন হয়। প্রভাবগুলি CO2 এর সম পরিমাণে মিলিত হতে পারে। নাইট্রোজেন সার মাটির ব্যাকটেরিয়া দ্বারা নাইট্রাস অক্সাইড, একটি গ্রিনহাউস গ্যাসে রূপান্তরিত হতে পারে। নাইট্রোজেন সার যার অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গমন ঘটে (NO, N2O, NO2) মারাত্মক বায়ু দূষণের জন্য দায়ী।

ওজোন হ্রাসের জন্য দায়ী অন্যান্য গ্যাসগুলি হল জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড এবং ক্লোরো-ফ্লুরো হাইড্রোকার্বন। নাইট্রাস অক্সাইড (N2O) কার্বন ডাই অক্সাইড এবং মিথেনের পরে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ গ্রিনহাউস গ্যাস হয়ে উঠেছে। এর গ্লোবাল ওয়ার্মিং সম্ভাবনা কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে ৩১০ গুণ বেশি। নাইট্রাস অক্সাইডের নির্গমন সংক্রান্ত প্রধান উদ্বেগের বিষয় হল গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রভাব এবং ওজোন ধ্বংসে নাইট্রাস অক্সাইডের ভূমিকা যা ফলস্বরূপ বায়ুমণ্ডলীয় "গর্ত" এর দিকে পরিচালিত করে, এইভাবে মানুষ এবং প্রাণীদের অত্যধিক অতিবেগুনী বিকিরণের সম্মুখীন হয়।

পানি দূষণে রাসায়নিক সারের প্রভাব

বেশি পরিমাণে কৃষি জমিতে রাসায়নিক প্রয়োগের ফলে সার ও কীটনাশক পানির সঙ্গে মিশে জলাধারের গিয়ে মিশে যায়। যা দীর্ঘমেয়াদে পানি দূষণের জন্য দায়ী। এ ছাড়া চাষ করা উচু জমিতে, মাইক্রোবায়াল কার্যকলাপের কারণে খনিজ এন-নাইট্রেটে জারিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলস্বরূপ, ভূগর্ভস্থ পানি একস্থান থেকে অন্য স্থানে সরে যায়। ভূপৃষ্ঠে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করলে ভূগর্ভের জলাধার ও পানির উৎসগুলোতে শেওলা বৃদ্ধি পায়। ফলে ভূগর্ভস্থ জলজ পরিবেশ নষ্ট হয়। এ ছাড়া অন্যান্য জলজ প্রজাতিও ক্ষতির মুখে পড়ে।

রাসায়নিক সার ব্যবহারের অন্যান্য প্রভাব

→ মাটিতে হিউমাসের ৮০ ক্ষয় ও তার পুষ্টি সঞ্চয় করার ক্ষমতা হ্রাস করে।
→ অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার থেকে প্রাপ্ত গ্রিনহাউস গ্যাস জলবায়ুর ক্ষতি করে।
→ প্রচুর পরিমাণে প্রয়োগ করা নাইট্রোজেন সময়ের সাথে সাথে মাটির ক্ষতি করে।
→ এঁটেল মাটির চেয়ে বেলে মাটি মাটির অম্লকরণের জন্য অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করে এই সার।
→ এঁটেল মাটির অতিরিক্ত রাসায়নিক নিষেকের প্রভাবকে বাফার করার ক্ষমতা রয়েছে।
→ রাসায়নিক সারের বারবার প্রয়োগের ফলে মাটিতে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম এবং ইউরেনিয়ামের মতো ভারী ধাতু বিষাক্ত পদার্থ জমা হতে পারে।
→ এই বিষাক্ত ভারী ধাতুগুলো খাদ্যশস্য, ফলমূল এবং শাকসবজিতেও জমা হয়।
→ জলজ প্রাণী ও বনজ উপকারি উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধি ও বিস্তার কমে গেছে। রাসায়নিক উপাদান পরিবেশে মিশে যাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
→ কৃষি উৎপাদনে রাসায়নিকের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে তা বাতাসের মাধ্যমে প্রাণীদেহে প্রবেশ করছে।
→ রাসায়নিক উপাদান মানবদেহে প্রবেশ করার ফলে নানা ধরণের দূরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে মানুষ।

 

তথ্যসূত্র- রিসার্চগেইট, ফারটিলাইজার ম্যাকানিকস ও উইকিপিডিয়া।

১৯ জুলাই ২০২২, ০২:১৬পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।