• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চাষাবাদে রাসায়নিক সার : ভয়ঙ্কর ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য

চাষাবাদে রাসায়নিক সার : ভয়ঙ্কর ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য

প্রতিকী ছবি

ফিচার ডেস্ক

জীবনের প্রয়োজনে আবিষ্কারের নেশায় বুদ হয়েছে মানুষ। ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা পূরণে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে আসছে। বৈশ্বিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে ধারা অব্যাহত রয়েছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে খাদ্য সংকট আরও বাড়তে পারে। আর তাই, খাদ্য চাহিদা পুরণ ও খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে আধুনিক কৃষি বিজ্ঞানীরা। বৈশ্বিক চাষাবাদে এসেছে আমুল পরিবর্তন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চলছে উন্নতমানের চাষাবাদ।

আপাতদৃষ্টিতে বিজ্ঞানের সঙ্গে কৃষির যে যোগসাজশ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে খাদ্য উৎপাদনে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যঝুঁকি যেন লাগামছাড়া রূপে আবির্ভূত হয়েছে। স্বাস্থ্য গবেষক ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, কৃষি ও উৎপাদিত খাদ্যপণ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। বিরল সব রোগের সৃষ্টি হচ্ছে পৃথিবীর দিকে দিকে। আর এ সব রোগের সূত্রপাত প্রধানত খাবার থেকেই।

বিখ্যাত স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবজার্নাল ড্রাগওয়াচার ডট ওআরজি এ সংক্রান্ত একটি চমকপ্রদ নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। যেখানে মানব স্বাস্থ্যের জন্য রাসায়নিক সার ও রাসায়নিকযুক্ত খাদ্যশস্যের নানা প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রিয় পাঠক, চলুন দেখে নেয়া যাক রাসায়নিকযুক্ত খাদ্যশস্য ও খাদ্যপণ্য আমাদের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর-

রাসায়নিক সার কি?

ড্রাগ ওয়াচার বলছেন, রাসায়নিক সার হল একটি প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম পদার্থ, যা উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহের উদ্দেশ্যে মাটিতে প্রয়োগ করা হয়। রাসায়নিক সার দুটি প্রকারে ভাগ করা যায়। যার একটি জৈব এবং অপরটি রাসায়নিক।

জৈব সার- এই সার উদ্ভিদ এবং পশুর মরদেহসহ জৈব উৎস থেকে আসে। এই সারগুলো খুবই পরিবেশ-বান্ধব কিন্তু বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এগুলো এখনো বৈশ্বিকভাবে প্রচলতি হয়ে ওঠেনি। কারণ জৈব সার ব্যবহার ব্যয়বহুল ও এতে আপাতত উৎপাদনশীলতাও কম।

রাসায়নিক সার- এটি ব্যাপক ব্যবহৃত একটি সার। এই সারের ব্যবহার ও উপকারিতা নিয়ে বিতর্ক বিশ্বব্যাপী। পরিবেশবিদরা খাদ্যশস্য উৎপাদনে রাসায়নিক সারের ব্যবহারের বিপক্ষে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। এই সার মূলত জৈব সারের চেয়ে অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ। কৃত্রিম উপায়ে রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রনে এই সার উৎপাদন করা হয়। এই সার দিয়ে উৎপাদিত খাদ্যশস্য ও খাদ্যপণ্য মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করে।

রাসায়নিক সার ও মানবস্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষকরা বলছেন, রাসায়নিক সারই কৃষি খাতের একমাত্র রাসায়নিক পদার্থ নয় যা পরিবেশ এবং মানব স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বরং এটি আরও বেশি বিতর্কিত। সম্ভাব্য ক্ষতিকারক রাসায়নিককে কীটনাশক বলা হয়। একটি কীটনাশক, অনেকটা রাসায়নিক সারের মতো, মানুষের জন্য এর স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকারক প্রভাবের জন্যও এই সার দায়ী। রাসায়নিক সার ব্যবহার করে যে খাদ্যপণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে, তা মানুষের দেহে শেষ আশ্রয় নিচ্ছে। মানুষ খাবার গ্রহণের মাধ্যমে রাসায়নিক সারের প্রভাব শরীরে নিচ্ছে। এটি আতঙ্কের বটে।

যেমন হবে স্বাস্থ্যঝুঁকি

রাসায়নিক কীটনাশক মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিস্তৃত নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। কীটনাশকের এক্সপোজার মানুষের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক সারের ব্যবহার পরিবেশ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সম্প্রতি আমেরিকার আদালতে দায়ের করা প্যারাকোয়াট মামলায় বলা হয়েছে, কীটনাশক এবং এর কথিত বিষাক্ত রাসায়নিকগুলি ফুসফুসের দাগ, ফুসফুসের ক্ষতি, কিডনি ব্যর্থতা, লিভারের ব্যর্থতা, হার্ট ফেইলিওর এবং কীটনাশক বিষক্রিয়ার কারণ হতে পারে।

অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্যারাকোয়াট ভেষজনাশক পারকিনসন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। কৃষক, কৃষি শ্রমিক এবং কীটনাশক প্রয়োগকারীরা কীটনাশক এক্সপোজার থেকে বিরূপ স্বাস্থ্যের প্রভাব ভোগ করার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, রাসায়নিকযুক্ত খাদ্যশস্য ও খাদ্যপণ্য মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

যেভাবে শরীরে প্রবেশ করে কীটনাশক

সার হল সম্ভাব্য ক্ষতিকারক রাসায়নিকের সংমিশ্রণ, যা গাছপালা দ্বারা শোষিত হয়। পরে এটি খাদ্যশস্য ও খাদ্যপণ্যের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। পানীয় জলের মাধ্যমেও রাসায়নিক মানুষের দেহে প্রবেশ করতে পারে।

রাসায়নিক সার দ্বারা সৃষ্ট প্রধান স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলোর মধ্যে একটি সম্ভবত উদ্ভিদের ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট যা নাইট্রোজেন, পটাসিয়াম এবং ফসফরাস রয়েছে তার মাধ্যমে ঘটতে পারে। রাসায়নিক সারের সমস্যা হল যে এটি মাটিতে অনুপ্রবেশ করতে পারে এবং ভূগর্ভস্থ পানিতে এমনকি নদী ও হ্রদের মতো ভূ-পৃষ্ঠের পানিতেও প্রবাহিত হতে পারে, যার ফলে দূষিত হতে পারে।

নাইট্রোজেন কয়েক বছর ধরে পানিতে থাকতে পারে, এতে নাইরেটস এবং নাইট্রাইটের অত্যধিক মাত্রা থাকতে পারে।

এ ছাড়া সিন্থেটিক সারের অত্যধিক ব্যবহারের সাথে আরেকটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা হল- ক্যান্সার। ১৯৭৩ সালের একটি গবেষণায় ভূগর্ভস্থ পানিতে উচ্চ মাত্রার সোডিয়াম নাইট্রেট গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের সাথে যুক্ত। কৃত্রিম সার বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ছয় গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে প্রোস্টেট ক্যান্সার, মস্তিষ্কের ক্যান্সার, নন-হজকিন্স লিম্ফোমা এবং লিউকেমিয়া। আর এ সবই হচ্ছে কেবল চাষাবাদে রাসায়নিক সারের ব্যবহারের ফলে।

পুষ্টি ও স্বাস্থ্যগবেষকদের আরেকটি পক্ষ দাবি করছে, অধিক ফলনের আশায় শাক-সবজি আবাদের সময় অতিরিক্ত সার কীটনাশক ও কৃত্রিম হরমোন ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে উৎপাদন বাড়লেও কৃষিপণ্যের খাদ্যমান তলানিতে গিয়ে ঠেকছে।

এধরণের কৃত্রিম হরমোন দিয়ে উৎপাদিত শাক-সবজি জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। অতিরিক্ত সার কীটনাশক ও কৃত্রিম হরমোন প্রয়োগে উৎপাদিত শাক-সবজি যেমন মানব দেহে বিভিন্ন রোগ ব্যধির অন্যতম কারণ হয়ে দাড়িয়েছে, তেমনি প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্রও রয়েছে হুমকির মুখে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

আধুনিক কৃষি বিজ্ঞান বলছে, ফসল উৎপাদনের জন্য কম পক্ষে ২১ টি মৌলিক উপাদান প্রয়োজন। এর মধ্যে তিনটি ম্যাক্রনিউট্রিয়ন্ট সবচেয়ে জরুরি। সেগুলো হল- কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন। আর এই তিনটি উপাদানই বাতাস ও পানি থেকে পাওয়া যায়।

এছাড়া প্রয়োজনীয় অন্য তিনটি ম্যাক্রনিউট্রিয়ন্ট নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম পাওয়া যায় মাটি থেকে। আবার তিনটি সেকেন্ডারি ম্যাক্রনিউট্রিয়ন্ট সালফার, ক্যালশিায়াম এবং ম্যাগনেশিয়াম মাটি থেকে পাওয়া যায়। এ ছাড়া আরও ১২টি মাইক্রোনিউট্রিয়ন্ট আয়রন, মলিবডেনাম, বোরোন, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, জিঙ্ক, নিকেল, ক্লোরিন, কোবাল্ট, এ্যালমুনিয়াম এবং সিলিকন আদর্শ মাটিতে থাকা প্রয়োজন।

আধুনিক কৃষি প্রবর্তনের পর থেকে মাটিতে মৌলিক উপাদানের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। যেমন ১৯৫১ সালে এ দেশের মাটিতে নাইট্রোজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। ১৯৫৭ সাল থেকে ঘাটতির তালিকায় নাইট্রোজেনের সাথে ফসফরাস যুক্ত হয়। ১৯৬০ সাল থেকে এ তালিকায় পটাশিয়াম যুক্ত হয়। ১৯৮০ সাল থেকে সালফার ও ঘাটতির তালিকায় যুক্ত হয়। ১৯৮২ সাল থেকে জিঙ্ক ঘাটতি তালিকায় যুক্ত হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে বোরোন ঘাটতির তালিকায় যুক্ত হয়। ২০০০ সাল থেকে ঘাটতির তালিকা আরো দীর্ঘ হয়েছে। এখন আটটি মৌলিক পদার্থ যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, জিঙ্ক, বোরোন, ম্যাগনেশিয়াম এবং মলিবডেনামের ঘাটতি নিয়ে চলছে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন। এখন যেভাবে চলছে এ ভাবে কৃত্রিম সার নির্ভর কৃষি উৎপাদন পরিচালিত হলে অদূর ভবিষ্যতে অন্তত ১৮ টি মৌলিক পদার্থ প্রয়োগ করেই এ দেশে ফসল উৎপাদন করতে হবে।

রাসায়নিকযুক্ত খাবারে যে ক্ষতি

♦ কপার সালফেট বা তুঁতের জলে ডোবানো শাকসবজি খেলে যকৃতের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

♦ ভেজাল মসলার গুঁড়া পাকস্থলী বা অন্ত্রের ক্ষতি করে।

♦ ইউরিয়া মেশানো মুড়ি ভাজা খেলে কিডনির ক্ষতি হয়।

♦ সন্দেশ বা পানে রুপার তবকের বদলে অ্যালুমিনিয়ামের তবক ব্যবহারে আলঝেইমার রোগ হতে পারে।

♦ লেড ক্রোমেট বা লেড আইয়োডাইড মেশানো হলুদের গুঁড়ো ব্যবহারে ক্যান্সারে ঝুঁকি বাড়ে।

♦ মেটালিক ইয়েলো বা কিশোরী রং খাবারে মেশালে চোখের ক্ষতি হতে পারে।

♦ খাবারে কীটনাশকের উপস্থিতির কারণে অ্যালার্জি হতে পারে। এ ছাড়া চোখ, ত্বকের ক্ষতি হয়।

♦ পেট খারাপ, বমি, চুলকানি, এনকেফেলাইটিস, রক্তস্বল্পতা, গর্ভপাত এবং বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে।

১৪ জুলাই ২০২২, ০৩:৫৩পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।