• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • রোববার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩১ ভাদ্র ১৪৩১

যেভাবে ‘হিরো’ যমুনা টেলিভিশন

যেভাবে ‘হিরো’ যমুনা টেলিভিশন

ফিচার ডেস্ক

জনপ্রিয়তার তুঙ্গে দেশের অন্যতম শীর্ষ গণমাধ্যম ‘যমুনা টেলিভিশন’। ২৪ এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সাক্ষী। ক্ষমতাসীনদের ইশারায় অন্য সব গণমাধ্যম যখন বাতাবি লেবু আর মিষ্টি কুমড়ার বাম্পার ফলনের সংবাদ প্রচারে ব্যস্ত ছিল। তখন, যমুনার সংবাদকর্মীরা ব্যস্ত ছিল ক্যামেরা আর বুম হাতে রাজপথে। যে রাজপথে দুই সপ্তাহের ক্র্যাকডাউনে অন্তত হাজার খানিক মানুষ শহীদ হয়েছে। এর মধ্যে বিক্ষুব্ধ ছাত্র রয়েছেন অন্তত ২৬০ এর অধিক। যমুনা টিভি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিপীড়ন ও হত্যার শিকার ছাত্র-জনতার আর্তনাদ তাদের পর্দায় তুলে ধরেছে নিয়মিত। তারা হাল ছাড়েনি।

যমুনা টিভি’র এই দুঃসাহসিক অগ্রযাত্রা ও প্রতিষ্ঠানটির নানা তথ্য নিয়ে আমাদের এই ছোট্ট প্রয়াস। চলুন দেখে নেয়া যাক-

যে ভাবে শুরু হয় যমুনার যাত্রা

২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সরকারি অনুমোদন পায় যমুনা টেলিভিশন। পরীক্ষামূলক সম্প্রচারে থাকা যমুনা টেলিভিশনকে ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর ফ্রিকোয়েন্সি ও যন্ত্রপাতি আমদানির অনুমোদন বাতিল সংক্রান্ত চিঠি দেয় বিটিআরসি। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর যমুনা টেলিভিশনের পরীক্ষামূলক সম্প্রচারও বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৭ মার্চ ২০১৪ সালে টেলিভিশন চ্যানেলটি দ্বিতীয়বারের মত পরীক্ষামূলক সম্প্রচারে আসে। ২০১৪ সালের ৫ এপ্রিল সংবাদভিত্তিক চ্যানেলটি পূর্ণাঙ্গ সম্প্রচারে আসে। আলোচিত সাংবাদিক সাইমন ড্রিং যমুনা টেলিভিশনের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। নিয়মিত সম্প্রচার ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউব ও ওয়েব পোর্টাল হিসেবে তথ্য ও সংবাদ প্রচার করছে গণমাধ্যমটি।

যমুনা টেলিভিশনের নেপথ্য কারিগর

বাংলাদেশের শিল্পগোষ্ঠী যমুনা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান যমুনা টেলিভিশন। গণমাধ্যমটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে কাজ করছে। টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফাহিম আহমেদ। তিনি যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বাবুলের জামাতা। ফাহিম আহমেদ এক সময় যমুনা টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে সংবাদমাধ্যমটিতে শতাধিক পেশাদার সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী কাজ করছেন। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশে সংবাদদাতা আছে গণমাধ্যমটির। যমুনা টিভির সদর দফতর রাজধানীর প্রগতি সরণী সংলগ্ন যমুনা ফিউচার পার্কের পাশে।

যমুনা টিভির অন্যান্য উদ্যোগ

সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশন, ডয়েচে ভেলেসহ নানান সংস্থার সঙ্গে সংযুক্ত গণমাধ্যমটি। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিভিন্ন প্রশিক্ষণমুলক কাজে যুক্ত যমুনা টিভি।

যেভাবে আলোচিত যমুনা

অনুসন্ধানমূলক অনুষ্ঠান ‘ইনভেস্টিগেশন ৩৬০ ডিগ্রি’ দিয়ে দেশব্যাপী আলোচিত হয়ে ওঠে যমুনা টিভি। এই অনুষ্ঠানটি দেশের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও অপরাধের লোমহর্ষক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী তুলে ধরেন নিয়মিত পর্বের মাধ্যমে। এর ফলে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অনুসন্ধান বিষয়ক নানান পুরস্কার অর্জন করে প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন সাংবাদিক।

এ ছাড়া আলোচিত বিভিন্ন অপরাধমুলক ঘটনার বিশ্লেষণভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘ক্রাইম সিন’, আন্তর্জাতিক বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘আই-ডেস্ক’, লাইফস্টাইল বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘সুন্দরের স্বপ্নে’, দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘সকালের বাংলাদেশ’, বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘টেকট্রেক’, সমসাময়িক রাজনীতি বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘চলতে চলতে’, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভাবনা নিয়ে আয়োজিত ‘ভয়েস’ অনুষ্ঠানমালা ব্যাপক দর্শক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

অর্জিত পুরস্কার

ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্র্যাব) আয়োজিত দুর্নীতি বিষয়ে সেরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ২০১৮ পুরস্কার ( অর্জনকারী- মো: আব্দুল্লাহ্ ( আব্দুল্লাহ্ তুহিন)।
মিডিয়া ফেলোশিপ পুরস্কার ২০২২ (অর্জনকারী: সাংবাদিক ফারহানা ন্যান্সি)।
‘আইনি বিপদগ্রস্তদের মঙ্গলার্থে অবদান’ ক্যাটাগরিতে ‘বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যালায়েন্স পুরস্কার-২০১৯’ (অর্জনকারী: স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ইব্রাহিম খলিল)।
দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার-২০২২ টেলিভিশন (প্রতিবেদন) (অর্জনকারী: অনুসন্ধানী সেলের সম্পাদক অপূর্ব আলাউদ্দিন)।
অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) ইআরএফ বেস্ট রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড (অর্জনকারী: আলমগীর হোসাইন)।
টিআইবি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার (২০১৬) (আলাউদ্দিন আহমেদ এবং জি এম ফায়সাল)।
বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন (ক্র্যাব) মাদক বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য পুরস্কার (অর্জন: সাজ্জাদ পারভেজ)।

যেভাবে বিস্ময় হয়ে উঠেছে যমুনা

এতকিছু অর্জন তার পরও সবকিছু ছাপিয়ে গেছে যমুনা টিভির বর্তমান জনপ্রিয়তা। গত জুলাই জুড়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র পরিষদ’ আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের শুরু থেকেই পক্ষপাত ভুলে, সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ শুরু করে যমুনা টেলিভিশন। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হওয়ার অন্যতম কারণ ‘১৮ জুলাই নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর চালানো গণহত্যা’ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ।

সদ্য বিলুপ্ত শেখ হাসিনা সরকারের রক্তচক্ষূ উপেক্ষা করে রাজধানীতে সংঘটিত মানবতাবিরোধী ছাত্র-জনতা গণহত্যার নির্মম ভিডিও চিত্র সংবাদের মাধ্যমে তুলে ধরে যমুনা টিভি। সারাদেশে যখন ইন্টারনেট বন্ধ করে নির্বিচারে গুলি করে ছাত্র-জনতাকে হত্যার মিশনে নামে সরকার। তখন সাহসের বারুদ বুকে নিয়ে ক্যামেরা আর বুম হাতে দাঁড়িয়ে যায় যমুনা টিভির অকুতোভয় সংবাদযোদ্ধারা। যমুনার এই যাত্রা অতটা সহজ ছিল না। তাদের অনেক সংবাদকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, আহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন সংবাদকর্মীরা। তারপরও তারা সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন।

যমুনার এই অসীম সাহসিকতায় ছাত্র-জনতা তাদের মনোবল ধরে রাখতে সচেষ্ট হয়। এমনকি আন্দোলনের মাঠে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা যমুনা টিভির প্রশংসায় স্লোগান দিতে থাকে। যমুনার সংবাদকর্মীদের কাছে পেয়ে তারা মাথায় তুলে উল্লাস করেছে। আর এভাবেই একটি অন্ধকার যুগের সমাপ্তি ঘটেছে, ফিরেছে আলো। যে আলোর অন্যতম কারিগর যমুনা টেলিভিশন।

১০ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৪৫এএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।