• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রণাঙ্গনের প্রথম প্রতিরোধ যেখানে, যেভাবে

রণাঙ্গনের প্রথম প্রতিরোধ যেখানে, যেভাবে

প্রতিকী ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

আজ ঐতিহাসিক ২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি সারাদেশে পালিত হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে বাংলাদেশের পদার্পণ। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গর্জে ওঠে বাঙালি বীর সন্তানেরা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাক বাহিনী। তবে ২৫ মার্চ কালো রাতের পর ২৬ মার্চ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ। এরপর আগে থেকেই দেশের কয়েকটি জায়গায় সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাক বাহিনী। এসব প্রতিরোধের ঘটনার মধ্যে প্রথম যেটি সংঘটিত হয়েছিল, সেটি গাজীপুরের (তৎকালীন জয়দেবপুর) ঘটনা। সেদিনের সেই লোমহর্ষক সম্মুখ যুদ্ধের স্মৃতি স্মরণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের সেই কাহিনী সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গ্রন্থ, প্রতিবেদন ও বর্ণনায় উঠে এসেছে প্রথম প্রতিরোধের গল্প।

‘১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণার পর গাজীপুরের (তৎকালীন জয়দেবপুর) জনগণ সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল পাক হানাদার ও মুক্তিকামী বাঙালিরা। ১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ দুপুরে হঠাৎ এক বেতার ভাষণে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন। এ কথা শোনামাত্রই সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। দেশের সর্বত্রই স্লোগান ওঠে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি-বাঙালি’।

ঢাকার পূর্বাণী হোটেলে এক সভায় ইয়াহিয়ার ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ২ মার্চ ও সারা বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ৩ মার্চ হরতাল আহ্বান করেন। ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা আহ্বান করেন।

২ মার্চ রাতে গাজীপুরের তৎকালীন থানা পশু পালন কর্মকর্তা আহম্মেদ ফজলুর রহমানের সরকারি বাসায় মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিব উল্লাহ সর্বদলীয় সভা আহ্বান করেন। সভায় আ ক ম মোজাম্মেল হককে আহ্বায়ক করে এবং মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির শ্রমিকনেতা নজরুল ইসলাম খানকে কোষাধ্যক্ষ করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট এক সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার আগেই এ কমিটি গঠন হয়েছিল। আ ক ম মোজাম্মেল হক ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। নিউক্লিয়াসের উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা, যা মূলত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৬২ সালেই ছাত্রলীগের মধ্যে গঠিত হয়েছিল।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যেই সশস্ত্র যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে বাঙালি সৈন্যদের মধ্যেও নিউক্লিয়াস গঠিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে, যার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যাবে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের দায়ের করা ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান’ মামলায়।

৭ মার্চ ১৯৭১, জয়দেবপুর (গাজীপুর) থেকে হাজার হাজার মানুষ ট্রেনে করে এবং শতাধিক ট্রাক ও বাসে করে মাথায় লাল ফিতা বেঁধে সোহরাওয়ার্দী (তৎকালীন রেসকোর্স) উদ্যানে জনসভায় যোগ দেন। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। ৭ মার্চ উজ্জীবিত হয়ে ১১ মার্চ গাজীপুর সমরাস্ত্র কারখানা (অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি) আক্রমণ করে ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’।

ওই সময় পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার কারখানার পেছনের গেট দিয়ে সালনা হয়ে পালিয়ে ঢাকায় চলে যান। পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার আর পরবর্তী সময়ে ১৫ এপ্রিলের আগে গাজীপুরে যায়নি। পাকিস্তান সমরাস্ত্র কারখানা ২৭ মার্চ পর্যন্ত বাঙালি স্বাধীনতাকামীদের দখলেই ছিল। সম্ভবত ১৩ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি সাহেবজাদা ইয়াকুব আলী জয়দেবপুর রাজবাড়ি মাঠে হেলিকপ্টারে অবতরণ করতে চেষ্টা করলে শত শত মানুষ হেলিকপ্টারে ইটপাটকেল ও জুতা ছুড়তে শুরু করে। উপায় না দেখে হেলিকপ্টার ফিরে যায়।

১৯ মার্চ শুক্রবার, আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার জাহান জেবের নেতৃত্বে পাকিস্তানি রেজিমেন্ট জয়দেবপুরের (গাজীপুর) দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার জন্য পৌঁছে যায়। একজন জেসিও (নায়েব সুবেদার) বাঙালি ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। পরে আ ক ম মোজাম্মেল হক তখনকার আবাসস্থল মুসলিম হোস্টেলের হাবিবউল্লা ও শহীদউল্লাহ বাচ্চু শিমুলতলীতে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, ডিজেল প্ল্যান্ট ও সমরাস্ত্র কারখানার শ্রমিকদের কাছে এ খবর পৌছে দেন। তখন হাজার হাজার শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ লাঠিসোঁটা, দা, কাতরা, ছেন, দোনলা বন্দুকসহ জয়দেবপুরে (গাজীপুর) উপস্থিত হয়।

সেদিন জয়দেবপুর হাটের দিন ছিল। জয়দেবপুর রেলগেটে মালগাড়ির বগি, রেলের অকেজো রেললাইন, স্লিপারসহ বড় বড় গাছের গুঁড়ি, কাঠ, বাঁশ, ইট ইত্যাদি যে যেভাবে পেরেছে তা দিয়ে ব্যারিকেড দেয় বিক্ষুব্ধরা।

জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত আরও পাঁচটি ব্যারিকেড দেওয়া হয়, যাতে পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্র নিয়ে ফেরত যেতে না পারে। দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ (পরবর্তীকালে প্রধান সেনাপতি)। আমরা যখন ব্যারিকেড দিচ্ছিলাম, তখন টাঙ্গাইল থেকে রেশন নিয়ে একটি কনভয় জয়দেবপুরে আসছিল। সে সময় কনভয়ে থাকা পাঁচজন সৈন্যের চায়নিজ রাইফেল তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয় বাঙালি শ্রমিকরা।

এ খবরে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গলের রেজিমেন্টকে ব্যারিকেড ভাঙার আদেশ দেয় ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব। কৌশল হিসেবে বাঙালি সৈন্যদের সামনে দিয়ে পেছনে পাঞ্জাবি সৈন্যদের অবস্থান নিয়ে মেজর সফিউল্লাহকে জনগণের ওপর গুলিবর্ষণের আদেশ দেয়া হয়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা জনতার ওপর গুলি না করে আকাশের দিকে গুলি ছুড়ে সামনে আসতে থাকলে হাজার হাজার শ্রমিক ও ছাত্ররা গাজীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ওপর অবস্থান নিয়ে বন্দুক ও চায়নিজ রাইফেল দিয়ে সেনাবাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে।

এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে জয়দেবপুরে শহীদ হন নেয়ামত ও মনু খলিফা। আহত হন ডা. ইউসুফসহ শত শত মানুষ। পাকিস্তানি বাহিনী কারফিউ জারি করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। বাঙালি শ্রমিক, ছাত্র ও সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। বর্তমানে সেই স্থানে চৌরাস্তার মোড়ে ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নামে ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে।

ইতিহাস বলছে, সেদিন বাঙালি বীর সন্তানেরা পিছু হটলেও প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের সাহস জুগিয়েছিল তৎকালীন জয়দেবপুর। যেখান থেকেই ধারণা ছড়িয়েছিল যে, পাক বাহিনীকে পরাস্ত করা সম্ভব। ঐক্যবদ্ধ থাকলে পাক হানাদারদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করা যাবেই যাবে।

আর তাই তো, ১৯৭১ এর ১৯ মার্চের পর সারা বাংলাদেশে স্লোগান ওঠে, ‘জয়দেবপুরের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘জয়দেবপুরের পথ ধরো, সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করো’। ১৯ মার্চের সশস্ত্র যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক মাইলফলক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৯ মার্চ জাতীয় জীবনে এক স্মরণীয় দিন।

২৬ মার্চ ২০২২, ০৫:৫৪পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।