• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গণমানুষের মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী

গণমানুষের মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী

ফাইল ছবি

ফিচার ডেস্ক

ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের গণনায়ক মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। যিনি জীবদ্দশায় ১৯৪৭-এ সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি ‘মজলুম জননেতা’ নামেই বেশি পরিচিত। বিবিসি বাংলা জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় প্রথম সারিতে রয়েছে কিংবদন্তী এই রাজনীতিক ও সমাজ সংস্কারক।

রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি মাওপন্থী কম্যুনিস্ট তথা বামধারার রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তার অনুসারীরা অনেকে এজন্য তাকে “রেড মওলানা” নামেও ডাকতেন। তিনি কৃষকদের জন্য পূর্ব পাকিস্তান কৃষক পার্টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য সারাদেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা।

জন্ম ও মৃত্যু

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া পল্লীতে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা হাজী শারাফত আলী। আবদুল হামিদ খানের ডাক নাম ছিল ‘চেগা মিয়া’। মহামারীতে তার বাবা, মা, ভাই-বোন সবাই মারা যায়। বেঁচে থাকেন কেবল শিশু আবদুল হামিদ খান। তিনি চাচার কাছে লালিত পালিত হওয়ার সময় ইরাক থেকে আলেম ও ধর্ম প্রচারক নাসির উদ্দীন বোগদাদী সিরাজগঞ্জে আসেন। হামিদ তার আশ্রয়ে কিছুদিন কাটান।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে ১৮৯৩ সালে তিনি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে যান এবং সেখানে তিনি মাদ্রাসার মোদাররেসের কাজ করে। ১৯২৫ সালে তিনি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন মহম্মদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিবাহ করেন।

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই দেশ বরেণ্য নেতা মৃত্যুবরণ করেন। তাকে টাংগাইল জেলার সদর উপজেলার উত্তর-পশ্চিমে সন্তোষে পীর শাহজামান দীঘির পাশে সমাধিস্থ করা হয়। সারাদেশ থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ তার জানাযায় অংশগ্রহণ করে।

সমাজ সংস্কার

রাজনীতির পাশাপাশি সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন মওলানা ভাসানী। জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে মহিপুর হক্কুল এবাদ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এই মিশনের অধীনে একটি মেডিকেল, টেকনিক্যাল স্কুল, মহীপুর হাজী মুহসিন সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া তিনি আসামে ৩০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। রয়েছে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখাপড়া

১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন আবদুল হামিদ খান। সেসময় তিনি ইসলামী শিক্ষার উদ্দেশ্যে দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে ভাসানী অণুপ্রাণিত হন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন আবদুল হামিদ খান। ওই সময় তিনি দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন।

আন্দোলন সংগ্রাম

১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানী সেই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৬ সালে তিনি তার সহধর্মিণী আলেমা খাতুনকে নিয়ে আসাম গমন করেন এবং আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটান। ১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এখান থেকেই তার নাম রাখা হয় “ভাসানীর মাওলানা”। এরপর থেকে তার নামের শেষে ভাসানী শব্দটি যুক্ত হয়।

১৯৩১ সালে সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩-এ গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

১৯৩৭ সালে ভাসানী কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। সেই সময়ে আসামে ‘লাইন প্রথা’ চালু হলে ওই নিপীড়নমূলক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। এসময় তিনি “আসাম চাষী মজুর সমিতি” গঠন করেন।

১৯৪০ সালে শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন ভাসানী। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৪৫-৪৬ সালে আসাম জুড়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে “বাঙ্গাল খেদাও” আন্দোলন শুরু হলে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দেয়। এসময় বাঙালিদের রক্ষার জন্য ভাসানী বারপেটা, গৌহাটিসহ আসামের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ান। পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৯৪৭ সালে আসামে গ্রেফতার হন।

১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।

বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জনবিরোধী কার্যকলাপের ফলে মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩ ২৪ জুন ঢাকার টিকাটুলিতে রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। ২৩ জুন ওই কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রধান অতিথি। ২৩ জুন পূর্ববঙ্গের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী সর্বসম্মতিক্রমে এই দলের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক।

১৯৪৯ সালে পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবীতে মওলানা ভাসানী ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। যে কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৭১ এর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন।

২৫ মার্চ রাতে মওলানা ভাসানী সন্তোষে তার গৃহে অবস্থান করছিলেন। তিনি পাকিস্তান বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে টাঙ্গাইল ছেড়ে তার পিতৃভূমি সিরাজগঞ্জে চলে যান এবং পরে তিনি ভারতে আশ্রয় নেন।

৭১’র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাওলানা ভাসানী চীনের নেতা মাও সে তুং, চৌ এন লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তারবার্তা পাঠিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা চালানোর বিষয়টি অবগত করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালে ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী।

মাওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করেন। মাওলানা ভাসানী বলেছিলেন, “আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার ত্রিপুরাও আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না।”

প্রকাশিত গ্রন্থ

মওলানা ভাসানী তার রাজনৈতিক দর্শন, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও ভাবধারায় ১৯৬২ সালে ‘দেশের সমস্যা ও সমাধান’ এবং ১৯৬৩ সালে ‘মাও সে তুং-এর দেশে’ রচনা করেন।

সম্মাননা

ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত কর। ২০০৪ সালে বিবিসি জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় তিনি ৮ম হন।

১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০৬:১১পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।