• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী নজরুল ইসলাম: বিদ্রোহী প্রেমের কবি

কাজী নজরুল ইসলাম: বিদ্রোহী প্রেমের কবি

ছবি- সংগৃহিত

ফিচার ডেস্ক

বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, জনতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে কাজী নজরুল ইসলাম সৃষ্টি করে গেছেন অবিস্মরণীয় সব সৃষ্টিকর্ম। কবিতার শাণিত ধারে তিনি বধ করে গেছেন অত্যাচারী শাসক থেকে জুলুম-শৃঙ্খল জঞ্জাল।

প্রথম জীবন

কাজী নজরুল ইসলামের দাদার নাম কাজী আমিন উল্লাহ। তাঁর বাবার কাজী ফকির আহমদ। ছোট বেলায় কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল “দুখু মিয়া”। নজরুল ইসলাম গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। মক্তবে কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে তাঁর বাবা মারা যান। মাত্র নয় বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে পারিবারিক অভাব-অনটনে পড়েন কাজী নজরুল ইসলাম।

স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে বিকশিত হয়েছিল একটি বিদ্রোহী সত্তা। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে কারাবন্দী করে। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অবিভক্ত ভারতের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তাকে বলা হতো বিদ্রোহী কবি।

পারিবারিক জীবন

১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন। তার সাথেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে যার সাথে তার প্রথমে প্রণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল।

তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনের নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

নজরুলের সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি

মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল) দলে যোগ দেন। লেটো দলেই তাঁর প্রথম সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন।

নজরুলের রচনা

সেই অল্প বয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন কাজী নজরুল ইসলাম। এর মধ্যে রয়েছে ‘চাষার সঙ’, ‘শকুনীবধ’, ‘রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ’, ‘দাতা কর্ণ’, ‘আকবর বাদশাহ’, ‘কবি কালিদাস’, ‘বিদ্যাভূতুম’, ‘রাজপুত্রের গান’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এবং ‘মেঘনাদ বধ’।

কাজী নজরুল ইসলাম ১৯১০ সালে লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। নতুন ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল। এরপর তিনি ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে, যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। মাথরুন স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তার সান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস।

তবে আর্থিক সমস্যার কারণে বেশি দিন পড়াশোনা করতে পারেননি নজরুল ইসলাম। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে। এরপর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে।

পরে কাজী নজরুল ইসলাম ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণি থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন।

১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন তিনি। সেনাবাহিনীতে ছিলেন প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়েছিলেন তিনি।

“করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল রচনা করেন- “বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী” (প্রথম গদ্য রচনা), “মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা)”, “হেনা”, “ব্যথার দান”, “মেহের নেগার”, “ঘুমের ঘোরে” (গল্প) এবং “সমাধি” কবিতা। করাচি সেনানিবাসে থাকা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা।

তাঁর শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ। ইসলামী সংগীত, গজল ও হামদ রচনায়ও নজরুল ইসলাম ছিলেন অনবদ্য।

সাংবাদিক কাজী নজরুল ইসলাম

যুদ্ধ শেষে কলকাতায় ফিলে কাজী নজরুল ইসলাম ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি থেকে প্রথশ সাহিত্য-সাংবাদিকতা শুরু করেন। প্রথম দিকে মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহর্রম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দম্, এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই ‘নবযুগ’ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন।

 

সম্মাননা

১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার জগত্তারিণী স্বর্ণপদক নজরুলকে প্রদান করা হয়। ১৯৬০ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণে ভূষিত করা হয়।

এ ছাড়া কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। তাঁর রচিত “চল্ চল্ চল্, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল” বাংলাদেশের রণসঙ্গীত হিসেবে গৃহীত। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।

বাংলাদেশে আগমন ও প্রয়াণ

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারি আদেশ জারী করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট বাংলাদেশের জাতীয় কবি এহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান।

০২ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:৫৯এএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।