• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
পর্ব-১

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: বিশ্বজয়ী বাঙালি কবি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: বিশ্বজয়ী বাঙালি কবি

ছবি- সংগৃহিত

ফিচার ডেস্ক

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা সাহিত্যের প্রাণ পুরুষ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা শেষ হবার নয়। সাহিত্যের এমন কোনো অংশ নেই, যেখানে তাঁর স্পর্শ পড়েনি। নোবেলজয়ী কীর্তিমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে ছিলেন গল্পকার, ছড়াকার, ঔপন্যাসিক, কবি, অনুবাদক। জীবদ্দশায় তিনি লিখে গেছেন ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত।

বিবিসি বাংলা জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় দ্বিতীয় জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের এই উজ্জ্বল প্রদীপ। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা ‘শ্রোতা জরিপ’ পরিচালনা করে। মাসব্যাপী চালানো জরিপের পর রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্ম নিয়ে অনুষ্ঠানও প্রচার করে বিবিসি।

বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ একটি স্বতন্ত্র ধারা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতকার, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিকের খেতাবের মুকুট তাই রবী ঠাকুরের মাথাতেই বেশি মানায়।

জন্ম ও কিছু কথা

১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতার এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিশু বয়সে প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি তিনি। গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মা সারদাসুন্দরী দেবী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর বাবামায়ের চতুর্দশ সন্তান। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়।

১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের (বর্তমান কুষ্টিয়া) শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে তিনি শান্তিনিকেতনেই স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯০২ সালে তাঁর স্ত্রী মারা যান। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

রবী ঠাকুরের শৈশব ও সাহিত্যে হাতেখড়ি

জমিদার পরিবারের সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আট বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রথম তাঁর “অভিলাষ” কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তার প্রথম প্রকাশিত রচনা।

আন্দোলন ও অর্জন

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে তৎকালীন বহুল আলোচিত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

পরে ১৯২১ সালে গ্রামীণ জনজীবনের উন্নয়নকল্পে তিনি পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন ‘শান্তিনিকেতন’। এ ছাড়া ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠ। করেন তিনি। কবি প্রতিভা ও সাহিত্যচর্চায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিশ্বকবি’ বা ‘কবিগুরু’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।

রবী ঠাকুরের কৈশোর

১৮৭৩ সালে এগারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাবার সঙ্গে কয়েক মাসের জন্য দেশভ্রমণে বের হন। প্রথমে তিনি আসেন শান্তিনিকেতনে। এরপর পাঞ্জাবের অমৃতসরে কিছুকাল কাটান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পাঞ্জাবে থাকাকালীন শিখদের উপাসনা পদ্ধতি অবলোকন করেন কিশোর রবী ঠাকুর। এরপর বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পাঞ্জাবেরই (ভারতের হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত) ডালহৌসি শৈলশহরের নিকট বক্রোটায়। বক্রোটা বাংলোয় থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাবার কাছ থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেন।

১৮৭৭ সালে ভারতী পত্রিকায় তরুণ রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। এগুলো হল- মাইকেল মধুসূদনের “মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা”, “ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী” এবং “ভিখারিণী” ও “করুণা” নামে দুটি গল্প। এর মধ্যে “ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কবিতাগুলো রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলির অনুকরণে “ভানুসিংহ” ভণিতায় রচিত। রবীন্দ্রনাথের “ভিখারিণী” গল্পটি (১৮৭৭) বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটগল্প। এরপর ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ তথা প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ “কবিকাহিনী”। ১৮৮২ সালে তিনি রচনা করেন সন্ধ্যাসংগীত কাব্যগ্রন্থটি। তাঁর বিখ্যাত কবিতা “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” সন্ধ্যাসংগীত কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত।

যৌবন

১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে তিনি ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। এরপর ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু সাহিত্যচর্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন শেকসপিয়র ও অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। এই সময় তিনি বিশেষ মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন রিলিজিও মেদিচি, কোরিওলেনাস এবং অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা। এই সময় তার ইংল্যান্ডবাসের অভিজ্ঞতার কথা ভারতী পত্রিকায় পত্রাকারে পাঠাতেন রবীন্দ্রনাথ। ওই পত্রিকায় এই লেখাগুলি জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমালোচনাসহ প্রকাশিত হত ‘ইউরোপযাত্রী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্রধারা’ নামে।

১৮৮১ সালে সেই পত্রাবলি ইউরোপ-প্রবাসীর পত্র নামে গ্রন্থাকারে ছাপা হয়। এটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যগ্রন্থ তথা প্রথম চলিত ভাষায় লেখা গ্রন্থ। ১৮৮০ সালে প্রায় দেড় বছর ব্যারিস্টারি পড়া শুরু না করেই ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফেরেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর (২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) ঠাকুরবাড়ির অধস্তন কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হয়। বিবাহিত জীবনে ভবতারিণীর নামকরণ হয়েছিল মৃণালিনী দেবী।

১৮৯১ সাল থেকে পাবনা ও রাজশাহী জেলা এবং উড়িষ্যার জমিদারি অংশের তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছিলেন। জমিদার রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে “পদ্মা” নামে একটি বিলাসবহুল পারিবারিক বজরায় চড়ে প্রজাবর্গের কাছে খাজনা আদায় ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে যেতেন।

১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘মানসী’ প্রকাশিত হয়। কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে তার আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ও গীতিসংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলি হলো প্রভাতসংগীত, শৈশবসঙ্গীত, রবিচ্ছায়া, কড়ি ও কোমল ইত্যাদি।

বিশ্বভ্রমণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট বারো বার বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে তিনি পাঁচটি মহাদেশের ত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন। প্রথম জীবনে দুই বার (১৮৭৮ ও ১৮৯০ সালে) তিনি ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। ১৯১২ সালে ব্যক্তিগত চিকিৎসার জন্য তৃতীয়বার ইংল্যান্ডে গিয়ে ইয়েটস প্রমুখ কয়েকজন ইংরেজ কবি ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে সদ্যরচিত গীতাঞ্জলি কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে শোনান। কবিতাগুলি শুনে তারাও মুগ্ধ হয়েছিলেন। ডব্লিউ বি ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের কাব্যের ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকাটি লিখে দিয়েছিলেন। এরপর এই ভ্রমণের সময়েই “দীনবন্ধু” চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে।

১৯২০-২১ সাল নাগাদ আবার ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান কবি। ওই সফরের সময় পাশ্চাত্য দেশগুলিতে তিনি সংবর্ধিত হয়েছিলেন। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ যান চীন সফরে। এরপর চীন থেকে জাপানে গিয়ে সেখানেও জাতীয়তাবাদবিরোধী বক্তৃতা দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯২৪ সালের শেষের দিকে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে সেদেশে যাওয়ার পথে আর্জেন্টিনায় অসুস্থ হয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথ্যে তিন মাস কাটান কবিগুরু। স্বাস্থ্যের কারণে পেরু ভ্রমণ তিনি স্থগিত করে দেন। পরে পেরু ও মেক্সিকো উভয় দেশের সরকারই বিশ্বভারতীকে ১ লাখ মার্কিন ডলার অর্থসাহায্য প্রদান করেন। ১৯২৬ সালে বেনিতো মুসোলিনির আমন্ত্রণে ইতালি সফরে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এরপর রবীন্দ্রনাথ গ্রিস, তুরস্ক ও মিশর ভ্রমণ করে ভারতে ফিরে আসেন।

শেষ জীবন

জীবনের শেষ দশকে রবীন্দ্রনাথের মোট পঞ্চাশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তার এই সময়কার কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২), ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩৫), ‘শ্যামলী ও পত্রপুট’ (১৯৩৬)। এই গদ্যকবিতা সংকলন তিনটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। জীবনের এই পর্বে সাহিত্যের নানা শাখায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন কবিগুরু। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ তার শেষ তিনটি উপন্যাসও (দুই বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) ও চার অধ্যায় (১৯৩৪)) শেষ বয়সে এসে রচনা করেছিলেন। বার্ধক্যে উপনীত হয়ে কবিগুরু সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি চিত্রকর্ম বা ছবি আঁকায় মনোযোগ দেন। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তার বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন ‘বিশ্বপরিচয়’। এই গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের আধুনিকতম সিদ্ধান্তগুলি সরল বাংলা গদ্যে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। চলবে...

২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০৩:০২পিএম, ঢাকা-বাংলাদেশ।